ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক কারণে গণদাবিতে মৃত্যুদণ্ডের প্রচলন অতীতে অনেক বেশি ছিল।
এই ধরনের গণদাবি ওঠানোর জন্য ক্ষমতাসীনরা অথবা ক্ষমতালোভীরা ম্যাস হিস্টেরিয়া (Mass hysteria) বা গণউন্মত্ততা সৃষ্টি করত।
গত শতাব্দিতে ম্যাস হিস্টেরিয়া বা গণউন্মত্ততার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ছিল ত্রিশের দশকে জার্মানিতে নাৎসি পার্টির উত্থান ও এডলফ হিটলারের ক্ষমতা লাভ। হিটলার ইহুদিদের বিরুদ্ধে গণউন্মত্ততা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন।
নাৎসি পার্টি ও তিনি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে জার্মানিতে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। পরিণতিতে জার্মান জাতিকে একটি কলংকিত যুগে তারা ঠেলে দিতে পেরেছিলেন। জার্মানিতে হয়েছিল গণহত্যা এবং বিশ্বে হয়েছিল ছয় বছর ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।
বিশ্বের মানুষ অবাক হয়ে মনে করেছিল সভ্য, শিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক ও কালচার্ড জাতির দেশ জার্মানিতে জন্ম হয়েছিল কার্ল মার্ক্স ও ফ্রেডরিখ এংগেলসের মতো মানবতাবাদী দার্শনিক, লুডউইগ বিথোভেনএর মতো সুরকার, এলবার্ট আইনস্টাইনের মতো বৈজ্ঞানিক, ইয়োহান গ্যেটে-র মতো কবি ও নাট্যকার, টমাস মানএর মতো ঔপন্যাসিক, এরিখ মারিয়া রেমার্কএর মতো লেখক এবং বহু নোবেল প্রাইজ বিজয়ী ও আবিষ্কারক। কিন্তু কিভাবে সেই দেশের মানুষকে ভেড়ার পালের মতো নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন হিটলার ও নাৎসি পার্টি?
গোটা জার্মান জাতি কিভাবে হারিয়েছিল মানবতাবোধ, বিবেক ও বুদ্ধি? সেই অন্ধকার যুগের খেসারত এখনো দিতে হচ্ছে জার্মান জাতিকে। থাকতে হচ্ছে বিশ্ব নিন্দার পাথর চাপা হয়ে। তাই জার্মান জাতি এখন আবার চেষ্টা করছে বিশ্ব প্রশংসা অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে। ২০১৪-তে ব্রাজিলে ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ফাইনালে জার্মানির চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা ছিল এই লক্ষ্যে জার্মান জাতির আরেকটি ধাপ উত্তরণ।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে আওয়ামী লীগও গণতান্ত্রিক এবং অগণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে এক দলীয় শাসন এবং একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে গিয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারাও ম্যাস হিস্টেরিয়া বা গণউন্মত্ততা সৃষ্টি করেছে। তবে আওয়ামী লীগ কখনোই বাংলাদেশকে ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ফাইনালে চ্যাম্পিয়ন করতে পারবে না।
শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের সামগ্রিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যই নয় সীমিত লক্ষ্য অর্জনের জন্যও ম্যাস হিস্টেরিয়া বা গণউন্মত্ততা সৃষ্টি করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে। যেমন, গত শতাব্দিতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে কমিউনিজমের উত্থান বন্ধ করার লক্ষ্যে সৃষ্টি করা হয়েছিল ম্যাকার্থিজম (McCarthyism)।
এই শতাব্দিতে বাংলাদেশে যুদ্ধ অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ডের এবং জামায়াতে ইসলামি পার্টি নিষিদ্ধ করার দাবিতে সৃষ্টি করা হয়েছিল শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মানুষও চিন্তা করবে কেন তাদেরই একটি বড় অংশ হারিয়ে ছিল মানবতাবোধ, বিবেক ও বুদ্ধি?
অষ্টাদশ শতাব্দির শেষ দিকে গণদাবিতে মানুষের মৃত্যু সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠে ফ্রেঞ্চ রিভলিউশনের সময়ে। তারপর থেকে বিভিন্ন দেশে মানুষ চেষ্টা করেছে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে দণ্ড দিতে। মানুষ সভ্যতার দিকে এগিয়ে গিয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশ সেদিকে যেতে পারেনি। এই একবিংশ শতাব্দিতেও বাংলাদেশে গণদাবিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে একটি এবসার্ড ঘটনায় বাংলাদেশে গত শতাব্দির শেষ প্রান্তে মৃত্যুদণ্ড রহিত করার গণদাবিও উঠেছিল।
তাহলে বাংলাদেশের মানুষ কোন দিকে? তারা কি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে? নাকি তারা মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে?
নিহত মোমবাতির শ্বাশ্বত চরিত্র
২০১৩ সালে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ঢাকার অতি ব্যস্ত পয়েন্ট, শাহবাগ চত্বরে বহু মানুষের সমাবেশ ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখার আবরণে এই সমাবেশ থেকে যুদ্ধ অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করা হয়। এর পরিণতিতে প্রচলিত আইন তড়িঘড়ি করে সংশোধনের পরে রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলির আবেদন ক্রমে জামায়াতে ইসলামি নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এর ফলে গণজাগরণ মঞ্চ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক নয় – মৃত্যুদণ্ডের প্রতীক হয়ে ওঠে। পাচ বছরের শিশুদের মাথায় কাগজের ব্যান্ডে ফাসি চাই লেখা নিয়ে সমবেত হন তাদের পিতামাতা। টিভি ক্যামেরার সামনে ওই শিশুদের সেøাগান দেওয়ান তাদের পিতামাতা। শিশুদের আধোবুলি দর্শকরা শোনেন, “ফাতি তাই।” ওই শিশু কি বোঝে, ফাসি কি? মৃত্যু কি?
মৃত্যুদণ্ডকামীরা ভুলে যান মোম ব্যবহৃত হয় মঙ্গল কামনায় (জন্মদিনে), আনন্দে (বিয়ে বার্ষিকীসহ বিভিন্ন এনিভারসারি ও খুশির ঘটনায়) উৎসবে (কৃসমাস, পূজায়), প্রেমে (স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকার ক্যানডল লাইট ডিনারে বা মোমের আলোতে পানাহারে), শান্তির দাবিতে (যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনে) শোক প্রকাশে (দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণার্থে) ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপনে (কবরস্থানে) । বিশ্বের সভ্য দেশগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত পথে গিয়ে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে মঙ্গল, আনন্দ, উৎসব, প্রেম, শান্তি, শোক ও শ্রদ্ধার প্রতীকের বদলে মোমবাতি হয়ে ওঠে হিংসা ও বিদ্বেষের, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার প্রতীক। শাহবাগে মিছিল হয় মোমবাতি হাতে ফাসির দাবিতে।
নিহত হয় মোমবাতির শ্বাশ্বত নম্র চরিত্র।
আর সেই ছবি প্রকাশিত হয় দেশের বিভিন্ন মিডিয়াতে।
অনেকের তখন মনে পড়ে যায় ফ্রেঞ্চ রিভলিউশনে দি রেইন অফ টেরর (The Reign of Terror, ৫ সেপ্টেম্বর ১৭৯৩ থেকে ২৮ জুলাই ১৯৭৪)-এর কথা। সেই সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বিপ্লবী দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক লড়াইয়ে সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করেন রাজনৈতিক নেতারা। সমবেত মানুষের মুখে মৃত্যুদণ্ডের দাবি তোলানোর ব্যবস্থা করতেন কুচক্রী ও ক্ষমতালোভী নেতারা। বিপ্লবের আবরণে আয়োজিত গণদাবিতে তখন ফ্রান্সে গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল ১৬,৫৯৪ জনের। এর মধ্যে শুধু প্যারিসেই মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল ২,৬৩৯ জনের। এ ছাড়া সারা ফ্রান্সে আরো প্রায় ২৫,০০০ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। এসব মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল গিলোটিনে। অবশ্য সেখানে গিলোটিনের পাশে কেউ মোমবাতি অথবা মঙ্গল প্রদীপ হাতে দাড়িয়ে ছিল না। সেখানে থাকত একটি ঠেলাগাড়ি যেখানে বোঝাই করা হতো রক্তাক্ত কাটা মুণ্ডু।
ফ্রান্সে অষ্টাদশ শতাব্দির শেষ প্রান্তে সেই এগার মাসে সব দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা সর্বক্ষণ ভীত ছিলেন, বিপ্লবের চেতনা সমুন্নত রাখার আবরণে যদি কোথাও প্রতিপক্ষ আয়োজিত জনসমাবেশ তাদের গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ডের দাবি তোলে তাহলে তাদের কি পরিণতি হবে? তাই সেই এগার মাসের শাসনকালের নাম হয়, দি রেইন অফ টেরর বা ভয়ের শাসনকাল ।
তবে ফ্রেঞ্চ রিভলিউশনের ২২০ বছর পরে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে শাহবাগের গণউন্মত্ততায় অনেক সচেতন নাগরিক যোগ দেন নি। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে অংশগ্রহণকারীদের সৌভাগ্য যে দেশের দুটি বড় হসপিটাল, বারডেম ও পিজি, দুই মাস যাবৎ রোগিদের দুর্গম স্থান হওয়ার ফলে যাদের অকাল মৃত্যু হয়েছে তাদের কোনো স্বজন বলেননি, কেন একজনের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে বহুজনের মৃত্যু ত্বরান্বিত করা হলো? শাহবাগিদের সৌভাগ্য যে ভুক্তভোগীরা শাহবাগিদের মৃত্যুদণ্ডের দাবি তোলেননি।
মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে বাংলাদেশের মিডিয়া
আওয়ামী লীগ সরকার এবং আওয়ামী সমর্থক মিডিয়ার অনুগৃহীত ও পৃষ্ঠপোষিত গণজাগরণ মঞ্চে ফাসির দাবিতে অনুপস্থিত ছিলেন খালেদা জিয়াসহ অন্যান্য বিএনপি নেতা, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, টিভি উপস্থাপক হানিফ সংকেত এবং গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিন (যিনি মুক্তিযুদ্ধের দুটি সবচেয়ে আবেগী গান, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এবং সব ক’টা জানালা, গেয়েছেন), ।
তবে সাবিনা ইয়াসমিনের ইনডিয়ান গায়ক-গীতিকার স্বামী কবির সুমন সেই সময়ে পাচটি কবিতা লিখেছিলেন। এর মধ্যে চারটি ছিল শাহবাগে উত্থাপিত মৃত্যুদণ্ডের দাবিকে সমর্থন জানিয়ে এবং একটি ছিল ইনডিয়াতে আফজাল গুরুর মৃত্যুদণ্ডকে নিন্দা জানিয়ে। প্রথমত, দ্বিতীয়ত, তৃতীয়ত এবং চতুর্থত বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড চাইলেও কেন পঞ্চমত তিনি ইনডিয়াতে মৃত্যুদণ্ড চাননি, এই প্রকট স্ববিরোধিতার কোনো উত্তর কবির সুমন এখনো দিতে পারেননি। প্রগতিশীলতার দাবিদারদের কাছে তিন মিনিটের মধ্যে প্রিয় হবার জন্যই কি “তিন মিনিট” শীর্ষক গানটি লিখেছিলেন একদা জনপ্রিয় কিন্তু বর্তমানে পপুলারিটি হাংগার-এ (Popularity Hunger) বা জনপ্রিয়তার খিদেয় অতিশয় কাতর এই গায়ক?
বিশ্বের সভ্য দেশগুলোর মিডিয়া মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার ফলে বিভিন্ন দেশে এই অসভ্য প্রথা এখন নিষিদ্ধ হয়েছে। তবে বাংলাদেশের মিডিয়ার অধিকাংশ এখনো মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে।
এদের যুক্তি হলো, এক. একাত্তরে যুদ্ধের সময়ে থাকা মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড করেছিল তাদের এবং / অথবা দুই. আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার চক্রাণ্ডে যারা লিপ্ত ছিল, তাদের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত।
দৈনিক প্রথম আলো এবং দি ডেইলি স্টারের মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে থাকার অতিরিক্ত আরেকটি কারণ থাকতে পারে। এই দুটি পত্রিকার কর্ণধার ট্রান্সকম গ্রুপের মালিক লতিফুর রহমানের কিশোরী কন্যা শাজনীন (১৫)কে নৃশংসভাবে খুনের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছে পাচ জন। প্রথম আলো এবং স্টারের সংশ্লিষ্ট কোনো সাংবাদিক-কর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী হতে চাইলেও, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পালনে তাদের মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে থাকতে হতে পারে।
মৃত্যুদণ্ডের প্রতি বাংলাদেশি মিডিয়ার প্রচণ্ড আসক্তি মাঝে মধ্যে অতিরিক্ত অশালীন রূপ ধারণ করেছে। দণ্ডিত মৃত ব্যক্তিদের পিতা-মাতা, বোন-ভাই, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এবং অন্যান্য নিকট আত্মীয় স্বজনের অনুভূতির প্রতি কোনো নমনীয়তা প্রকাশ করা তো দূরের কথা বরং মিডিয়ার উদগ্র উল্লাস চরম মানবতা বিরোধী রূপ ধারণ করেছে। যেমন, জেল হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত পাচ জনের ফাসির আগে দৈনিক সমকালের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি কালার কার্টুন প্রকাশিত হয়েছিল, যাতে দেখান হয়েছিল ফাসির মঞ্চের চারপাশে সমবেত হয়েছে উল্লসিত আবালবৃদ্ধবনিতা। সেখানে হাসিমুখে একটি শিশু উকি দিয়ে দেখছে ফাসিকাঠ। চ্যানেল আই গ্রুপের সাপ্তাহিক পত্রিকা সাপ্তাহিক Ñএর ৩ ডিসেম্বর ২০০৯-এর প্রচ্ছদে হেডলাইন ছিল যে ফাসি হাসি ফোটায়। গোলাম মোর্তোজা সম্পাদিত এই সংখ্যাটির ওই কভার স্টোরির একটি লাইন ছিল, এই ফাসি প্রতিটি বাঙালির মুখেই হাসি ফোটাবে (পৃ: ১৪)।
প্রতিটি বাঙালির মুখেই?
প্রশ্ন হচ্ছে, যে পাচ ব্যক্তির ফাসি হয়েছিল, তাদের পিতা-মাতা, বোন-ভাই, স্ত্রী-পুত্র ও কন্যাদের মুখেও কি হাসি ফুটেছিল?
ধারাবাহিক নাটক ও এবসার্ড ঘটনা
বাংলাদেশের মানুষ মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে, নাকি বিপক্ষে, এই প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে, কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড তারা চায় না এবং সেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে সেটা রহিত করার জন্য তারা দেশব্যাপী আন্দোলন করতে পারে। এই সত্যটা প্রতিষ্ঠিত হয় গত শতাব্দিতে নব্বইয়ের দশকে। মজার কথা এই যে একটি কাল্পনিক ব্যক্তির ফাসির দণ্ড রোধ করতে বাংলাদেশে এই আন্দোলন হয়েছিল।
১৯৯২-এ বাংলাদেশ টেলিভিশন কর্পরেশন (বিটিভি)-তে সম্প্রচারিত হচ্ছিল হুমায়ূন আহমেদের লেখা ধারাবাহিক নাটক কোথাও কেউ নেই।
এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম ছিল বাকেরভাই। সে ছিল মাস্তান টাইপের এবং তার দুই সঙ্গী ছিল বদি ও মজনু। তারা তিনজন মোটর সাইকেলে ঘুরতো। অধিকাংশ সময়ে মোটর সাইকেল চালাতো মজনু। বদি বসতো মাঝখানে। বাকেরভাই পিছনে।
বাকেরভাইয়ের একটা মুদ্রাদোষ ছিল। সে একটা চেইন হাতের তর্জনিতে অবিরাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পেচাতো। আবার তারপর উল্টো দিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্যাচ খুলে আবার পেচাতো। যখন বাকেরভাইয়ের কোনো সংলাপ থাকতো না, তখন তাকে এটা করতে দেখা যেত।
বাকেরভাইকে ভালোবাসতো গরিব পরিবারের একটি মেয়ে মুনা। সে চাকরি করতো এবং তার মামাতো ভাইবোনদের দেখাশোনা করতো।
এলাকায় সন্ত্রাসী রূপে বাকেরভাইয়ের দুর্নাম থাকলেও বেশির ভাগ মানুষ তাকে ভালোবাসতো। কারণ, বাকেরভাই সত্যের পক্ষে দাড়াতো। নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাড়াতো। সমাজের অন্যায়কে সহ্য করতো না। নিজের মাস্তানদের নিয়ে কঠোর হাতে দমন করতো অন্যায় অবিচারকে।
ঘটনাচক্রে বাকেরভাই এলাকার প্রভাবশালী এক নারীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। ওই নারী তার বাড়িতে অবৈধ কার্যকলাপে লিপ্ত ছিলেন। বাকেরভাই সেটা জানতে পেরে প্রতিবাদ করে। ওই নারী তার বাড়িতে কুকুর পালতেন। তাই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন কুত্তাওয়ালি নামে।
হঠাৎ এক রাতে কুত্তাওয়ালির বাড়িতে একজন খুন হয়। কুত্তাওয়ালির দারোয়ান মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় যে বাকেরভাই ছিল খুনি।
আদালতে বাকেরভাইয়ের উকিল বারবার প্রমাণ করে দেন ওই দারোয়ান মিথ্যা বলছে। কিন্তু মামলার মোড় ঘুরে যায়, যখন কুত্তাওয়ালি লোভ দেখিয়ে বাকেরভাইয়ের শিষ্য বদিকে হাত করে নেন। আদালতে কোরআন ছুয়ে বাকেরভাইয়ের বিরুদ্ধে বদি মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়। ফলে আদালত ওই খুনের দায়ে মিথ্যা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বাকেরভাইকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
অথচ বাকেরভাই ছিল নির্দোষ। বাকেরভাইয়ের উকিল তাকে বাচানোর জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
আদালতের এই রায়ে মুনা ভেঙ্গে পড়ে। তার স্বজনরা তাকে ছেড়ে চলে যায়।
বাকেরভাইয়ের ফাসি হয়ে যায়।
জেল কর্তৃপক্ষ ভোরে বাকেরভাইর লাশ হস্তান্তর করেন মুনাকে। সেই লাশ নেওয়ার জন্য একমাত্র মুনাই ছিল। বাকেরভাইকে কবর দেওয়ার পরে মুনা একা হয়ে যায়।
নাটকের শেষ দৃশ্যে ভোরের আলো-আধারিতে ছায়া হয়ে মুনা একা প্রান্তরে দাড়িয়ে থাকে।
কোথাও কেউ ছিল না।
কোথাও কেউ নেই ধারাবাহিক নাটকের প্রতিটি পর্বের জন্য প্রবল আগ্রহ নিয়ে দর্শকরা অপেক্ষা করতো। নাটকের অগ্রগতির সাথে সাথে দর্শকরা অ্যান্টি হিরো বাকেরভাইকে ভালোবেসে ফেলে। বাকেরভাইয়ের পক্ষে দেশব্যাপী জনমত গড়ে ওঠে। নাটকের শেষ দিকে যখন দর্শকরা আচ করে নির্দোষ সত্ত্বেও বাকেরভাইয়ের মৃত্যুদণ্ড হতে পারে তখন জনমত রূপান্তরিত হয় আন্দোলনে। প্রতিবাদী দর্শকরা দেশজুড়ে মিছিল করতে থাকে। সেøাগান দিতে থাকে :
বাকেরভাইয়ের ফাসি কেন? কুত্তাওয়ালি জবাব চাই।
বাকেরভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।
দেয়াল লিখনে ভরে যায় বাংলাদেশের শহরগুলো। পত্রিপত্রিকায় প্রতিদিন এসব খবর প্রকাশিত হতে থাকে।
এক পর্যায়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে নাট্যকার হুমায়ুন আহমেদ গণদাবি মেনে নেবেন। ফলে নাটকের শেষ দৃশ্যে বাকেরভাইকে নির্দোষ ঘোষণা করা হবে এবং সে ফাসিকাঠে ঝুলবে না।
কিন্তু সম্প্রচারিত নাটকের শেষ দৃশ্যে বাকেরভাইয়ের মৃত্যুদণ্ডই হয়।
তবে তারপরেও এই বিষয়ে গুজব ছড়াতে থাকে। এসব গুজবে বলা হয় হুমায়ূন আহমেদ তার নাটকের দুটি সমাপ্তি দিয়েছিলেন। একটিতে বাকেরভাইয়ের মৃত্যুদণ্ড হবে। এবং অন্যটিতে বাকেরভাই ছাড়া পেয়ে যাবে। এই দুটি বিকল্প সমাপ্তির মধ্যে যে কোনো একটিকে বেছে নেওয়ার সুযোগ তিনি দিয়েছিলেন নাটকের প্রযোজক মি. বরকতউল্লাহকে।
এ বিষয়ে আমাকে প্রযোজক বরকতউল্লাহ বলেন, না। হুমায়ূন আহমেদ দুটি সমাপ্তি দেন নি।
বকরতউল্লাহ আরো জানান, বাকেরভাইয়ের মৃত্যুদণ্ড বিরোধী আন্দোলন সহিংস রূপ নিতে পারে এবং সেটা বাকেরভাইয়ের স্রষ্টার বিরুদ্ধেই ধাবিত হতে পারে সেটা বুঝে তিনি (বরকতউল্লাহ) রমনা থানায় একটি জিডি করেন। পুলিশের উপদেশে হুমায়ূন আহমেদ তার এক বন্ধুর বাড়িতে আত্মগোপনে চলে যান। বরকতউল্লাহ নিজেও তার বাসা সাময়িকভাবে বদল করেন। দুই প্লাটুন পুলিশ নিয়োজিত হয় পাহারায়।
পরবর্তীকালে একটি ইন্টারভিউতে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, তিনি তার পূর্বকল্পিত সমাপ্তি বজায় রেখেছিলেন জনসাধারণকে বোঝাতে যে সম্পূর্ণ নির্দোষ এক ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে পড়ে আদালতে মৃত্যুদণ্ড পেতে পারে।
আরেকটি সূত্র বলেছে, নেত্রকোনায় কেন্দুয়াতে এই ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছিল এবং হয়তো হুমায়ূন আহমেদ সেটা ভিত্তি করে নাটকটি লিখেছিলেন।
অ্যাবসার্ড (Absurd) নাটক লিখেছেন স্যামুয়েল বেকেট (ওয়েটিং ফর গদো), লুইজি পিরানদেল্লো (সিক্স ক্যারেকটার্স ইন সার্চ অফ অ্যান অথর), হ্যারল্ড পিনটার (দি কেয়ারটেকার), ইউজিন আয়োনেস্কো (রাইনোসেরস), প্রমুখ। কিন্তু নাটক নিয়ে এমন অ্যাবসার্ড ঘটনা বোধহয় শুধু বাংলাদেশেই ঘটেছে। সেটা যাই হোক না কেন, এই অবিশ্বাস্য উদ্ভট ঘটনা প্রমাণ করে দেয় নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বিরোধী বাংলাদেশের মানুষ। একটি কল্পিত চরিত্রের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে যদি মানুষ এভাবে দাড়ায়, তাহলে বাস্তবে যদি কখনো প্রমাণিত হয়ে যায় যে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও মৃত মানুষটি নির্দোষ ছিল, তাহলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কি রূপ ধারণ করবে সেটা অকল্পনীয়।
বাকেরভাই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর, এখন আওয়ামী লীগের এমপি। মুনা চরিত্রে ছিলেন সুবর্ণা মোস্তাফা, উকিল চরিত্রে হুমায়ুন ফরীদি (এখন প্রয়াত) ও বদি চরিত্রে আবদুল কাদের।
নাট্যজীবনে আসাদুজ্জামান নূর বুঝেছিলেন একটি কল্পিত নির্দোষ ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড পেতে পারে। বাস্তব জীবনেও যে এমনটা ঘটতে পারে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির দোষ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকলে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী যে হওয়া উচিত সেটা তিনি বোঝেননি। শাহবাগে মৃত্যুদণ্ডের গণদাবি প্রশমনের কোনো চেষ্টা তিনি করেননি। দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে তিনি উঠতে পারেননি। বাকেরভাই যদি বাস্তব ও জীবিত হতেন তাহলে মানবিক কারণে আসাদুজ্জামান নূর কি করতেন?
গণদাবিতে মৃত্যুদণ্ডের প্রতিক্রিয়া
কোথাও কেউ নেই নাটকের পরিণতি দর্শকরা বিক্ষোভ সত্ত্বেও মেনে নিয়েছিল বলে তাদের সহিংসতাও কল্পিত থেকে গিয়েছে। কিন্তু ফ্রেঞ্চ রিভলিউশনে গণদাবিতে গণমৃত্যুর কি পরিণতি হয়েছিল? গণদাবির উস্কানিদাতা ও আয়োজকদের জন্য সেই তথ্যটি ভয়ংকর।
ফ্রেঞ্চ আইনজীবী ও পলিটিশিয়ান ম্যাক্সমিলিয়েন ফ্রাসোয়া মারি ইসিডোর ডি রোবেসপিয়ের (সংক্ষেপে রোবেসপিয়ের, Robespierre, ৬ মে ১৭৫৮ – ২৮ জুলাই ১৭৯৪) ছিলেন ফ্রেঞ্চ রিভলিউশনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি সুবক্তা, বামপন্থী ও সকল দুর্নীতির ঊর্ধ্বে রূপে পরিচিত হয়েছিলেন; কিন্তু রিভলিউশন বা বিপ্লবের একপর্যায়ে তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দিতে এবং রাজনীতি বিশুদ্ধ করতে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে চলে যান। তিনি চিহ্নিত হন রেইন অফ টেরর বা ভয়ের শাসনকালের প্রাণপুরুষরূপে।
প্যারিস এবং ফ্রান্সের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপ্লব বিরোধীদের মৃত্যুদণ্ডের গণদাবিতে বহু ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে থাকে। একপর্যায়ে বিপ্লবীরাই পরস্পরকে মৃত্যুদণ্ড দিতে থাকে এবং দণ্ড দেয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দণ্ডিত ব্যক্তিদের শিরñেদ করা হতে থাকে। এসব ক্ষেত্রে কোনো আইন মানা হতো না। খুব সংক্ষিপ্ত বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো এবং গিলোটিনে পাঠিয়ে দেয়া হতো।
এই নৈরাজ্য চরমে উঠে গেলে ফ্রেঞ্চ রিভলিউশনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরুষ জর্জ জ্যাক দান্তো (১৭৫৯-১৭৯৪) গণদাবিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া বন্ধ করতে চান। মানবিক কারণে দান্তো মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। এর ফলে রোবেসপিয়ের তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দান্তোকে সরিয়ে ফেলার সুযোগ পেয়ে যান। তিনি অভিযোগ করেন, দান্তো বিপ্লবী চেতনা থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। দান্তোর মৃত্যুদণ্ডের দাবি ওঠানো হয় এবং গিলোটিনে তার শিরñেদ করা হয়।
কিন্তু এর পর থেকে ঘটনার মোড় ঘুরে যেতে থাকে। মৃত্যুদণ্ড পিপাসুরা বুঝতে পারেন, এভাবে চললে, দান্তোর মতো তাদেরও একদিন গিলোটিনে মরতে হতে পারে। পাইকারি হারে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনমত সংগঠিত হয়।
বিপ্লবী সংগঠন দি কনভেনশন-এর নির্দেশে এক দল সৈন্য যায় রোবেসপিয়ের, তার ভাই অগাস্টি, সহযোগী কুথো, সেইন্ট জাস্ট, ফ্রাসোয়া হ্যানরিও এবং লা বাস-কে গ্রেফতার করতে। বিপদ দেখে অগাস্টি দোতলা থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়েন। তার দুই পা ভেঙে যায়।
রোবেসপিয়ের পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করতে যান; কিন্তু তিনি মারা যান না। তার চোয়ালের নিচের অংশ গুরুতর জখম হয়। সেই রাতে আহত রোবেসপিয়েরকে একটি ঘরে টেবিলের উপর শুইয়ে রাখা হয়। অবিরাম রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য একজন ডাক্তার ডেকে আনা হয়। তিনি মোটা ব্যানডেজ বেঁধে রক্তক্ষরণ বন্ধ করেন। যে ঘরে রোবেসপিয়েরকে রাখা হয়েছিল সেই ঘরেই রাজা ষোড়শ লুইয়ের স্ত্রী মারি আন্তোনে-কে তার শিরñেদের আগে রাখা হয়েছিল।
পরদিন ২৮ জুলাই ১৭৯৪-এ কোনো বিচার ছাড়াই প্যারিসে প্লাস ডি লা রিভলিউশনে রোবেসপিয়ের (৩৬) ও তার ভাই অগাস্টিসহ বারোজনের শিরñেদ করা হয়।
গিলোটিনের নিচে রোবেসপিয়ের যখন মাথা পেতে ছিলেন তখন, তার কাছে গিয়ে জল্লাদ, সুষ্ঠুভাবে যেন শিরñেদ হতে পারে, সেই লক্ষ্যে ভাঙ্গা চোয়ালে বাধা ব্যানডেজ খুলে ফেলেন।
তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠেন রোবেসপিয়ের।
গিলোটিনের ব্লেড তার ঘাড়ে না পড়া পর্যন্ত তিনি চিৎকার করছিলেন।
এমনই ভয়াবহভাবে মৃত্যু হয়েছিল গণদাবিতে মৃত্যুদণ্ড দানকারী বিপ্লবী কিন্তু কুচক্রী রোবেসপিয়েরের।
(চলবে)