২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার প্রথম মাসেই সংঘটিত বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ সরাসরি জড়িত বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। স্থানীয় সময় গতকাল রোববার সেন্ট্রাল লন্ডনের পার্ক প্লাজা রিভারব্যাংক হোটেলে নাগরিক সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, চট্টগ্রাম বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। দর্শকসারিতে ছিলেন তারেক রহমানের স্ত্রী ড. জোবায়দা রহমান।
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ‘সেদিন দেশের ভালো ভালো দেশপ্রেমিক ৫৭ জন অফিসারকে হত্যা করা হয়েছিল। সবকিছুই হাসিনা ও মইন জানত। সেদিন কর্নেল গুলজার সন্ধ্যা পর্যন্ত সেনাপ্রধানের সহযোগিতা কামনা করেছিলেন। সেদিন আর্মি যদি ঢুকতে পারত তা হলে তাদের বাঁচানো যেত। কিন্তু তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।’
সফর ব্যক্তিগত
খালেদা জিয়া তাঁর দীর্ঘ বক্তব্যে বলেন, ‘আপনারা এমন এক দেশে (ইংল্যান্ড) বসবাস করছেন, যে দেশকে বলা হয় মাদার অব ডেমোক্রেসি। আমি এবার এই দেশে এসেছি মূলত একদম ব্যক্তিগত সফরে।
অনেকদিন আমরা পরিবারের কাছ থেকে দূরে ছিলাম। পরিবারের সাথে সময় কাটানোর জন্যই এসেছি। তারপরও আপনাদের সাথে দেখা করব বলে আজ এখানে এসেছি।’
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে ভালো আছি, সুস্থ আছি। পরিবারের সাথে বহুদিন পর দেখা। তারা আমাকে ছাড়তে চায় না। তাই দেশে যেতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার দেশে যাওয়াটা প্রয়োজন। আমি দেশে যাব। আমাকে ছাড়া ওখানে অনেক কিছুই তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।’
খালেদা জিয়া প্রবাসীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা দেশ নিয়ে ভাবেন, দেশ নিয়ে চিন্তিত। খুব ভালো লাগছে। এই দেড় মাসে অনেক জিনিস দেখেছি, আমার ভালো লেগেছে। আইনশৃঙ্খলা থেকে শেখার আছে। এই দেশের মতো এইগুলি দেশে করলে ভালো হবে। প্রথমে আমাদের সুশৃঙ্খল হতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে শৃঙ্খলার অভাব, ঐক্যের অভাব আছে।’
লেডি হিটলার
সাবেক সরকারপ্রধান বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কী হয়েছিল তা আপনার জানেন। আমি সেগুলি বলব না। বর্তমানে বাংলাদেশে কী হচ্ছে তাও আপনারা দেখছেন। বাংলাদেশের মানুষ মোটেও ভালো নেই। সুশাসন বলতে কিছু নেই। আমি শেখ হাসিনাকে রং হেডেড বলতে চাই না। তিনি বাংলাদেশ রাজতন্ত্র কায়েম করতে চান।’ তিনি শেখ হাসিনাকে লেডি হিটলার উল্লেখ করে বলেন, ‘তিনি যা হুকুম করেন প্রশাসন তা করে। প্রশাসন দলীয়করণ করা হয়েছে। ভালো ভালো যোগ্য অফিসারকে বের করা দেওয়া হয়েছে। এখনো ৪০০-এর ওপরে ওএসডি করে রাখা হয়েছে। প্রশাসন অকার্যকর। বাংলাদেশের এডিপির যে কাজ আছে তা শেষ করতে পারে না। বড় বড় প্রজেক্টের কমিশন নেওয়া হচ্ছে।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের সমালোচনা করে বিএনপি নেত্রী বলেন, ‘কমিশন এই সকল দুর্নীতি দেখে না। তারা শুধু দেখে খালেদা জিয়ার পরিবারকে।’
নোংরা ঢাকা
খালেদা জিয়া বলেন, ঢাকা শহর চলার অনুপযুক্ত। ঢাকা শহর এত নোংরা, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ শহরের তালিকায় অবস্থান করছে। ডাস্টবিনগুলো আবর্জনায় উপচে পড়ছে।
ঐক্যবদ্ধ বিএনপি
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ‘বিএনপি ঐক্যবদ্ধ, আছে ঐক্যবদ্ধ থাকবে। সকল স্থানীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হয়। তাই আমরা বিগত নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়েছি। সিলেটে, রাজশাহীতে, খুলনায় গাজীপুরে, বরিশালে জয়ী হয়েছিলাম সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ায়। কিন্তু পরে ঢাকা সিটি নির্বাচন কী হয়েছে আপনারা জানেন। আমার ওপর হামলা হয়েছে। যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হতো তা হলে আমরা জয়ী হতাম। ভোটের দিন কী হয়েছে তা আপনারা দেখেছেন। যখন শুনলাম, আমাদের লোকজন ভোটকেন্দ্রে যেতে পারছে না তখন আমরা বয়কট করলাম। অনেকেই বলছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে গেলে বিএনপি জয়ী হতে পারত। কিন্তু সেটি ভুল। কারণ প্রশাসনে তাদের লোকজন ছিল। সিটি করপোরেশনের মতো রেজাল্ট হতো। এখন তো এই সরকারকে অবৈধ বলতে পারতেন না। বিদেশিরা তখন বৈধতা দিত। এখন পর্যন্ত কারো কাছ থেকে এরা বৈধতা পায়নি।’
আমাকে জেলে দেওয়ার পাঁয়তারা
সরকারের উদ্দেশে বিএনপি নেত্রী বলেন, ‘বর্তমান অবৈধ পার্লামেন্টে যতকিছুই পাস করুন না কেন সত্যিকারের নির্বাচন হলে জনগণের সরকার আসলে এগুলি কার্যকর হবে না। দেশ আজ গণতন্ত্রহীন অবস্থায়। কিছু হলেই বিএনপিকে দোষারোপ করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপির সব নেতাকে জেলে দিয়ে, এমনকি আমাকেও জেলে দিয়ে নির্বাচন করার পাঁয়তারা করছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের দেখলেই গুলি করছে পুলিশ। বিএনপিকে শেষ করার পরিকল্পনা করেছে অবৈধ সরকার।’
বেনজিরের বিচার হবে
খালেদা জিয়া আরো বলেন, ‘বিএনপিকে ভাঙা যাবে না। ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন অনেক করেছে। তারেক রহমানকে, কোকোকে রিমান্ডের নামে নিযার্তন করা হয়েছে। কোকো তো ভয় পেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ভয়ে ভয়েই থাকত।’ র্যাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেনজির কত মানুষ যে মেরেছে। তার বিচার হবে। শেখ হাসিনা জাতিসংঘে পর্যন্ত বলেছে দেশে জঙ্গিবাদ আছে। এখন আবার বলছে নাই। কিন্তু জঙ্গিদের উত্থান তাদের সময় ঘটেছে। যশোরে উদীচী, রমনার বটমূলে, গোপালগঞ্জে, সিপিবি সমাবেশে হামলা তাদের সময়। আমরা সব জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছিলাম। বিচার করেছিলাম।’ র্যাবকে জাতিসংঘ মিশন থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।
অর্থনীতি সম্পর্কে সাবেক সরকারপ্রধান বলেন, ‘মন্ত্রী-এমপিরা মুহিত সাহেবের কথা শোনে না। ব্যাংকগুলি শূন্য, শেয়ারমার্কেট, গার্মেন্টস শেষ হয়ে যাচ্ছে। ক্রেতারা বাংলাদেশে যেতে চায়, তারা ভয় পায়। লোকবল সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।’
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন কোনো ধর্মের মানুষ নিরাপদ নয়। এসবের সঙ্গে তার পুলিশ ও র্যাব জড়িত। র্যাবের জাতিসংঘ মিশন বন্ধ করতে হবে। তাদের গুলি সাপ্লাই বন্ধ করতে হবে। দেশে কেউ কথা বলতে পারে না। আপনারা যাঁরা প্রবাসে আছেন লেখালেখি করুন। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করুন।’