সাফী নামে একজন ভদ্রলোক আরিফ রহমান ভাইয়ের একটি
পোস্ট “কসাই কাদের আর মোল্লা কাদের নাকি এক ব্যাক্তি ছিলেন না; বীরাঙ্গনা মোমেনা বেগম আমায় ক্ষমা করবেন…” এ একটি মন্তব্য করেছেন।
অনেক মন্তব্যের ভেতর এই মন্তব্যটি আমার নজর কেড়েছে এবং একই সাথে বিরক্তিও উৎপাদন করেছে একটা ব্যাপার যে মোটামুটি অনেক যায়গাতেই শুনেছি এই গুজব যে, এই কাদের মোল্লা সেই কাদের মোল্লা না, সাক্ষী মোমেনা ভুয়া ইত্যাদি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমি এই ব্যাপারগুলো পর্যালোচনা করেছি আমার নিজস্ব চিন্তা, চেতনা এবং অবশ্যই আইনী বলয় থেকে। এই পুরো ব্যাপারটি-ই যেহেতু আইনী ব্যাপার, সুতরাং গুজবে কান দেয়ার এখানে কোনো রকমের সুযোগ নেই।
অভিজিৎ’দা সাফী সাহেবের এই মন্তব্যটি আমার নজরে এনেছেন, প্রথমেই অভিজিৎ’দা কে অনেক ধন্যবাদ। এই মন্তব্য না পড়লে এই বিষয়ে এই দীর্ঘ লেখাটি হয়ত হোতো না। আমি মনে করি সাফী সাহেবের এই মন্তব্যের উত্তর দেবার ফলে কাদের মোল্লা বিষয়ক নানান গুজবের অবসান হবে এবং সাক্ষী মোমেনাকে নিয়েও মিথ্যাচার শেষ হবে।
এই লেখা পড়বার আগেই আমি দেখে নেই সাফী সাহেব আসলে কি মন্তব্য করেছেন। তার মন্তব্যটি পাওয়া যাবে এখানে-
সাফী সাহেবের মন্তব্য । সাফী সাহেবের মন্তব্যের উত্তরে আমার প্রতি উত্তর-
আপনার মন্তব্যটি পড়লাম। খানিকটা অবাকও হলাম, আবার একটা পর্যায়ে ধরেই নিলাম আসলে একটা সুনির্দিষ্ট চিন্তার বলয় থেকে বের না হতে চাইলে যা হয়, আপনার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। একটি সঠিক কন্সেপ্ট বা ব্যাপার নিয়েও যেখানে প্রশ্ন করা যায় সেখানে আইনী এই ব্যাপারে এই জাতীয় প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে, এভাবেও আমি ব্যাপারটিকে দেখছি। ওভারঅল, আপনার প্রশ্ন করাকে আমি স্বাগত জানাই এবং আপনার এই প্রশ্নের মাধ্যমে সাক্ষী মোমেনা কিংবা কাদের মোল্লার কিছু বিচার সংক্রান্ত ব্যাপার সবার জানার স্বার্থেই আমি আলোচনা করতে চাই। আসুন এক এক করে আপনার মন্তব্যের জবাব দেই।
বিচারপতি ইস্যুঃ
আপনি শুরুতেই যে বিচারপতিদের নিয়ে আব্দুল কাদের মোল্লার ন্যায় বিচার পাবার আশংকা ব্যাক্ত করেছেন দুইজন বিচারপতির দিকে ইঙ্গিত করে সেটা আসলে হাস্যকর। কেননা, জামাত আজ পর্যন্ত এই ট্রাইবুনালের কোন বিচারপতিকে নিয়ে তাদের শংকার কথা জানায়নি? যেখানে এই ট্রাইবুনালটাই তারা পলিটিকাল হস্তক্ষেপে হচ্ছে বলে, বার বার বলবার চেষ্টা চালাচ্ছে সেখানে বিচারপতি তো সেই অভিযোগের প্রাথমিক পর্যায়ের এলিমেন্ট। এটা বলা বাহুল্য।
আপনাকে এই বিষয়ে একটি মজার তথ্য দেই। জামাত একটা সময় যখন এই ট্রাইবুনালকে নিয়ে পুরো পৃথিবীতে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছিলো তখন তারা বলছিলো যে এই ট্রাইবুনালে সব বিচারপতি দলীয় নিয়োগ পাওয়া, তারা আগে থেকেই মাইন্ড সেট আপ করে এসেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি…
কিন্তু গত বছর যখন মাননীয় বিচারপতি জহির আহমেদ তাঁর ব্যাক্তিগত অসুস্থতার কারনে ট্রাইবুনাল থেকে সরে দাঁড়ালেন তখন জামাতের আইনজীবিরা প্রচন্ড উচ্চকিত হয়ে উঠলেন এই বলে যে, বিচারপতি জহির আহমেদ খুব নিরপেক্ষ বিচারপতি ছিলেন। অথচ, এতদিন তারা সব বিচারপতিকেই বায়াসড কিংবা সরকারী হুকুম তামিল করছে, এসব বলেই অভিহিত করছিলেন। সুতরাং জামাতের এসবের দাবীর আসলে সঠিক কোনো লিগাল স্ট্যান্ড নেই, যৌক্তিকতা নেই কিংবা স্থিরতা নেই। এটি এদের চলমান ফাজলামো।
আপনি খুব সম্ভবত বিচারপতিদের ব্যাপারে শংকার কথা বলার ব্যাপারটিতে রেফার করছেন
স্কাইপি কনভারসেশনের ঘটনাটি। যদিও এই ব্যাপারটি একটি বিচারাধীন ব্যাপার এবং এটি এখনও প্রমাণিত বা রিজলভড কোনো ব্যাপার নয়, তাই একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি এই ব্যাপারে খুব বেশী কথা বলতে পারিনা সাব-জুডিস ম্যাটার হবার কারনে। কিন্তু আপনি যদি সেই কনভারসেশনে উল্লেখিত মাননীয় বিচারপতি সিনহা কিংবা বিচারপতি মানিকের [কনভারসেশনে তাঁর নাম আসেনি যদিও] কথা ইঙ্গিত করেন [ধরে নিচ্ছি তাদের কথাই বলছেন কেননা বিভিন্ন জামাতী পেইজে এদের নামে বিষাদ্গার দেখেছি] তবে বলতে হয় আপনি আসলে কিছু জামাতী গৎবাঁধা বুলি ছাড়া আর কিছুই বলছেন না। স্বাধীনতার পক্ষের কোনো ব্যাক্তিকে কিংবা স্বাধীনতার পক্ষে স্ট্রংলি কাজ করেছেন বা এই রকমের ইতিহাস রয়েছে এমন কিছু মানুষদের দেখলেই জামাতীদের শরীর জ্বলে। ধরা যাক, আজকে বিচারপতি সিনহা কিংবা মানিক সাহেবকে না রেখে বিচারপতি ফজলে এলাহী কিংবা নাজমুন নাহারকে সেখানে রাখা হোতো, কেউ কি গ্যারান্টি দিতে পারে যে জামাত সোনামুখ করে ভালো বিচার হচ্ছে… ভালো বিচার হচ্ছে… করে রব উঠাতো? কখনই না।
এই ট্রাইবুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ করাটা জামাতের একটা স্ট্র্যাটেজি। আমি এই হিসেবে আগেই উদাহরণ দিয়েছি বিচারপতি আফজালের কথা উল্লেখ করে। কিন্তু এখানে সিগনিফিকেন্ট লিগাল কোশ্চেন হচ্ছে, যেই ইস্যুতে বিচারপতি সিনহার ব্যাপারে জামাত প্রশ্ন তুলছে সেই ইস্যু হচ্ছে আরেকজন বিচারপতির একটা কনভারসেশন অন্য আরেকজন ব্যাক্তির সাথে। এখন একজন মানুষের কনভারসেশনের কথার উপর ভিত্তি করে [যেটি আবার আদালতে বিচারাধীন] একজন আপীলেট ডিভিশনের বিচারপতিকে বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দিবে? এটা তো জামাতের মুল্লুক নয়, এটা তো আপনাদের ইচ্ছাধীন বিচারালয়ও নয়।
জাস্টিস জ্যাকসন যেমন ২য় বিশ্বযুদ্ধের বিচার শুরুর প্রাক্কালে বলেছিলেন যে,
“অভিযুক্ত অপরাধীদের হাতেই নিশ্চয় আমরা বিচার করবার ভার দিতে পারিনা, এমন ভার দিলে কি হয় তা আমরা ১ম বিশ্ব যুদ্ধেই দেখেছি”
আবার অক্সফোর্ডের অধ্যাপক এ এল গুড হার্ট এই একই প্রসঙ্গে বলেছেন,
“কোনো দেশে গুপ্তচর বৃত্তির অপরাধের বিচার তো আমরা আসলে সেই গুপ্তচরের দেশকে দিতে পারিনা। গুপ্তচরের বিচার করবে যেই দেশে সে গুপ্তচর বৃত্তি করেছে সে দেশে এবং বিচার করবেও সেই দেশের আদালত। এই ক্ষেত্রে বিচার নিরপেক্ষ হয়নি, এমন দাবী তুলবার সুযোগ নেই”
এই প্রসঙ্গে লর্ড রীট বলেছেন,
“ একজন চোর নিশ্চই অভিযোগ করতে পারেন না যে কেন তার বিচার সৎ লোক করছে”
এমন দাবী শুধু আপনি আজ করেন নি। নুরেম্বার্গ ট্রায়ালে উঠেছিলো, ইয়াশামিতা ট্রায়ালে উঠেছিলো। কিন্তু সেসব দাবী আসলে ধোপে টেকে না।
সুতরাং যে দু’জন বিচারপতির বিরুদ্ধে শুরুতেই আবদুল কাদের মোল্লা ন্যায় বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে অনাস্থা জানিয়েছিলেন সেটি হাস্যকর দাবী। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের প্র্যাকটিসে এই দাবী অসাড়।
সাক্ষী মোমেনা ইস্যুঃ
সাক্ষী মোমেনা ইস্যু আসলে কোনঠাসা অপরাধীদের একটা নোংরা প্রোপাগান্ডা। জামাত যতই ইসলামের কথা বলুক না কেন, কাজে কর্মে তারা বরাবরই গোয়েবলস নামের এই ব্যাক্তির কর্মকান্ডই মূলত অনুসরণ করেছেন। জামাত এবং তাদের মিডিয়া সব সময় একটা বার্নিং ইস্যু থেকে চট করে কয়েকটা বাজারী কথা ছড়িয়ে দেয়, মানুষের মুখে মুখে সেগুলো ফিরতে থাকে এবং এন্ড অফ দা ডে সেটি নিয়ে তারা বাজার গরম করে তোলে। যদিও শেষ পর্যন্ত এই ইস্যুগুলো টেকে না কিন্তু তারা মানুষের ভেতর একটা সন্দেহের বীজ দিতে তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। সে রকম ইস্যুর ভেতর রয়েছে মেশিন ম্যানের চন্দ্র ভ্রমণ, এই সাকা সেই সাকা না বরং সাকা তখন ছিলো পাকিস্তানে, এই দেইল্যা সেই দেইল্যা না, এই কাদের সেই কাদের না এটা অন্য কাদের ইত্যাদি ইত্যাদি। এইতো সেদিন এন টিভির এক লাইভ টক শো-তে গেলাম। এক ব্যাক্তি ফোন করে বললেন, “এই নিঝুমকে তো আমরা দুইবার জুতাপেটা করেছি”, হাসতে হাসতে মরে যাবার মত অবস্থা হোলো সবার। আসলে মনের গহীনের দুষ্টু কল্পনা গুলোকে একটা পর্যায়ে মানসিক বিকার গ্রস্থেরা বিশ্বাস করতে শুরু করে আর তখন সেটি আসলে ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায়। কল্পনা করা হয়ত মন্দ না, কিন্তু সেই কল্পনাকে বাস্তব চরিত্র দিয়ে রূপদান করা শুধু অন্যায়-ই নয় বরং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আপনি মোমেনার সাক্ষ্যের এই বিষয় কোনোদিন সাহস করে আনতে পারতেন না যদি আপনি এই কাদের মোল্লার মামলার দুইটি রায় মন দিয়ে পড়তেন। একটি রায়, আই মিন
প্রথমটি ট্রাইবুনাল-২ এর ১৩২ পৃষ্ঠার রায় আর ২য়টি উক্ত রায় আপীলে যাবার পর
আপীলেট ডিভিশন থেকে ৭৯০ পাতার দীর্ঘ রায়। ভার্ডিক্ট না পড়ে কিংবা বিচারপতিরা একটি সুনির্দিষ্ট বিষয় কিভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বা আসল ফ্যাক্ট টি কি, এসব না পড়ে তর্ক করতে আসা মূর্খতা বলে আমি মনে করি।
মোমেনার ইস্যুটি খুব সাধারণ একটি ব্যাপার। মোমেনা মূলত তার জীবনে একবারই সাক্ষ্য দিয়েছেন তার পিতা-মাতা আর ভাই-বোন হত্যা মামলায়। আর সারা জীবন যদি কোন বক্তব্য দিয়ে থাকেন তবে সেটি একটি প্রোপার বিচার ব্যাবস্থায় আইন কিংবা কানুন মানা সাক্ষ্য হয়েছে, এই বিবেচনায় ধর্তব্য, আদারোয়াইজ, এই ধরনের কথার কোনো দাম পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো আদালতে নেই।
আপনি মোমেনার যেই জবানবন্দীর কথা বলেছেন যেটি তিনি মিরপুরের জল্লাদ খানার যে যাদুঘর কর্তৃপক্ষকে দিয়েছেন বলে আপনি কিংবা অভিযুক্তের আইনজীবি দাবী করছেন সেটি আদালত সম্পূর্ণ ভাবে অসাড় হিসেবে অভিহিত করেছেন। যখনই আপনি এই জাতীয় অভিযোগ করবেন তখন আপনার ঘাড়েই দায় বর্তায় আপনার বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করবার, প্রসিকিউশনের উপর নয়। কাদেরের আইনজীবি একটা কাগজ নিয়ে এসেছে ছবি ফরম্যাটে[ফটোস্ট্যাট] যাতে কোনো কর্তৃপক্ষের সাক্ষর নেই, সাক্ষ্য দাতার সাক্ষর নেই, এটি কিভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে সেটির ব্যাখ্যা নেই কিংবা বলতে পারেনি, এই বিচারের আইনের ধারা ৯, সাব সেকশন ৫ এর নিয়ম ফলো করা হয়নি, এটা সৌর্ন কোনো সাক্ষ্য নয়। [এই অংশের সত্যতা নিরূপনে আমি রেফার করছি ট্রাইবুনাল-২ এর মামলার রায়, পৃষ্ঠা ১১৯, প্যারা ৩৯১-৩৯২]
উপরের যে আইনী বাধ্যবাধকতা মূলক ল্যাকিংস গুলো আসামী পক্ষের থেকে রয়েছে, সেটি ব্যাতিরেকে এখন যদি আপনি দাবী তোলেন যে এই ধরনের সাক্ষ্য গ্রহন করতে তবে এন্ড অফ দা ডে আমি বলব, আপনারাই আসলে বাধ্য করছেন বা প্রেশার ক্রিয়েট করছেন যে এই কোর্ট ক্যাঙ্গারু কোর্ট হয়ে যাক, শুধু মাত্র আপনাদের স্বার্থের সময় আর বাকী সময় আইনের এই থ্রেশ হোল্ড না মানলেও চলবে। আজকে যদি সেইম ব্যাপারটা প্রসিকিউশনের কেউ করতে চাইত এবং বিচারক একই স্ট্যান্ড নিত, তবে কি আপনি বলতেন না যে আইন রক্ষিত হয়েছে? তবে কেন নিজেদের সুবিধা হয়, এমন মুহুর্ত গুলোতেই প্রোপাগান্ডা বা মিথ্যে ছড়ান?
আমি যদি ধরেও নেই মোমেনা বেগম যাদুঘর কর্তৃপক্ষকে এই সাক্ষ্য দিয়েছে সেখানেও কথা থাকে। আমি এই জবানবন্দী পড়েছি। যদিও সঠিক বাক্য হবে এটি মোমেনার বক্তব্য এর প্রেক্ষিতে যাদুঘর কর্তৃপক্ষের অনুলিখন, [যদি বক্তব্য দিয়েছেন ধরে নেই] যেমন, উক্ত সময়ে বা উক্ত এলাকায় ঐ ঘটনার প্রেক্ষিতে একজন ভিক্টিমের বক্তব্য কি ছিলো। এখানে মোমেনার উদ্ধৃতি দিয়ে যা বলছেন সেটা এমন নয় যে সেটি প্রথম পুরুষ ব্যাকরণে বলা হচ্ছে যেমন, “আমি মোমেনা এই মর্মে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে…”
আমি মোমেনার এই বক্তব্য
দৈনিক সংগ্রামে পড়েছি। পড়েই বোঝা যায় যে এখানে কত রকমের দূর্বলতা আছে, এই দূর্বলতা বুঝবার জন্য আমাকে আপীলেট ডিভিশানের বিচারপতি কিংবা মহকুমার হাকিম হবারও প্রয়োজন পড়ে না আসলে। একজন সাধারণ ব্যাক্তিই বুঝবেন এটি দেখার সাথে সাথে। এই বক্তব্যে কাদের মোল্লার নাম বলা দূরে থাকুক, বিহারী আক্তার গুন্ডা, হাক্কা কিংবা নেহাল গুন্ডার নামও নেই যেই নামগুলো এই আলী লস্কর হত্যা মামলায় বার বার এসেছে কাদেরের সহযোগী হিসেবে। এই কারো নাম না বলাটাই আসলে অনেক কিছু প্রমাণ করে যে, যাদুঘর কর্তৃপক্ষ মূলত মূল ঘটনার বর্ণনা দিতে চেয়েছেন কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাক্তির নাম উল্লেখ ব্যাতীত। এটা তাদের একটা স্ট্র্যাটেজী হতে পারে হয়ত, যেহেতু তখন পর্যন্ত এই সুনির্দিষ্ট অপরাধ প্রমাণিত ছিলো না। এছাড়াও আপনি যেমন প্রশ্ন তুলছেন,
“মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাছে বক্তব্য প্রদানের আগে মোমেনা বেগমকে কেউ ভয়-ভীতি দেখিয়েছিলেন এমন অভিযোগ করার সুযাগ নেই। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাছে ২০০৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তিনি এই বক্তব্য দিয়েছেন। তখন বর্তমান সরকারের পূর্বসূরি জরুরি আইনের সরকার ক্ষমতায়। জরুরি আইনের সরকারের তত্ত্বাবধানেই সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম গঠিত হয় যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে। তখন তারা খুবই সোচ্চার ছিলেন। সুতরাং মোমেনা বেগম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে নির্বিঘ্নে, নিঃসংকোচে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বলার সুযোগ নেই বৈরী সরকার থাকায় সঠিক বক্তব্য তখন দিতে পারেননি”
এই বক্তব্যও একেবারেই ফালতু যুক্তি। যাদুঘর কর্তৃপক্ষ বক্তব্য টিকেই এমন ভাবে উপস্থাপন করেছেন যেখানে ঘটনার সময়কালীন বর্ণনাকে মুখ্য কয়রে তোলা হয়েছে, অপরাধীদের পরিচয়টিকে নয়। সেটি কেন যাদুঘর কর্তৃপক্ষ করেছেন কিংবা কাদের মোল্লা বাদ দিন, কেন আকতার গুন্ডা, নেহাল বা হাক্কার নামও সেখানে আসেনি সেটি যাদুঘর কর্তৃপক্ষ জবাব দেবে। মোমেনার জবাব দেবার স্থান বা সুযোগ এখানে একেবারেই নেই। আমি আগেই বলেছি, মোমেনা আদৌ এই বক্তব্য দিয়েছেন কিনা, কিংবা তার বক্তব্যের কতটুকু যাদুঘর কর্তৃপক্ষ নিয়ে লিখেছেন সেটার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই প্রমাণ আইন মেনে হাজির করতে সম্পূর্ণ ভাবে অভিযুক্তের আইনজীবিরা পরাস্ত। এই না পারা কিংবা এই পরাজিত হবার খায়েশ যদি এখন সাফি সাহেব আপনাকে দিয়ে কিংবা বাঁশের কেল্লাকে দিয়ে কেউ মেটায় তবে এক্ষেত্রে আমার কিছুই করবার নেই কিংবা বলবার নেই।
ট্রাইবুনাল এই ক্ষেত্রে বলেছে-
393. Besides, Inaccuracies or inconsistencies between the content of testimony made under solemn declaration to the Tribunal and their earlier statement made to any person, non-judicial body or organisation alone is not a ground for believing that the witnesses have given false testimony. Additionally, false testimony requires the necessary mens rea and not a mere wrongful statement. We do not find any indication that the witnesses with mens rea have deposed before the Tribunal by making exaggeration.
394. For the reasons above, the Tribunal refrains from taking the account made to a non-judicial body into consideration for the purpose of determining credibility of testimony of witnesses made before the tribunal.”
এখানে একটি গুরত্বপূর্ণ মামলার নজির না দিলেই নয়। আপনারা জানেন যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান আসামী কর্ণেল ফারুক, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করবার পর-ই নানান টিভি, রেডিও তে পরিষ্কারভাবে বলেছে যে, সে বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছে বা খুনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। আপনারা শুনলে অবাক হবেন, এইভাবে টিভিতে সরাসরি স্বীকার করবার পরেও, এইভাবে স্পস্ট ভাবে বলবার পরেও কিন্তু আদালতে এই ভিডিও, এই ফুটেজ এবং এই বক্তব্য এসব পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেই এটি এভিডেন্স হিসেবে ছাড়পত্র পেয়েছে এবং এটিকে সেইক্ষেত্রে এই সাক্ষ্যকে সাক্ষ্য আইনের অনেক রকম মানদন্ড পেরিয়েই তবে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যাবহার করবার উপযোগী করতে হয়েছে। এরকম ভাবে একটা ভিডিও থাকবার পরেও ফারুক যে খুনী সেটি প্রমাণ করতে সময় লেগেছে পাক্কা দুইটি বছর কেননা ফারুক এই মামলায় আইন-কানুন মেনে দেয়া জবানবন্দীতে তার আগের বক্তব্যকে পাশ কাটাতে চেয়েছিলো। আর সেই হিসেবে এই মামলায় আসামী পক্ষের আইনজীবি প্রমাণ নেই, কিছু নেই, কোত্থেকে একটা ফটোকপি নিয়ে এসে বলছে এটা নাকি মোমেনার জবানবন্দী। সত্যিই বিষ্ময়কর!!
ট্রাইবুনালের রায়ের ১১৯ নাম্বার পৃষ্ঠায় আদালত এও বলেন যে, প্রসিকিউশন সাক্ষী যদি দুই রকম স্টেটমেন্ট দিয়ে থাকেও তবে সেই ক্ষেত্রে সাক্ষীর মেন্স রিয়া [Mens Rea] প্রমাণ করতে হবে, শুধু মাত্র সাক্ষ্যের ইঙ্কন্সিস্টেন্সি বা অসামঞ্জস্যতা প্রমাণ করতে পারলেই হবে না।
এই একই যুক্তি কিন্তু গ্রহন করেছে আপীলেট ডিভিশানের চার বিচারপতি, শধু মাত্র বিচারপতি ওয়াহাব মিয়া ছাড়া। তাও ওয়াহাব মিয়া মতামত দিয়েছেন যে ট্রাইবুনাল আরো একটু সময় দিয়ে জল্লাদখানার কর্তা ব্যাক্তিদেরও আবেদন অনুযায়ী সমন জারি করিয়ে সাক্ষ্য দিতে পারত। কিন্তু তিনি এও বলেছেন যে, প্রসিজিউরাল কোনো ফ্লস তিনি পান নি একেবারেই। এই বিষয় নিয়েও যখন আসামী পক্ষ রিভিউ এর দিন প্যাঁচ খেলতে চেষ্টা করেন, তখন বিচারপতি ওয়াহাব কি বলেছেন শুনে নিন-
আসামী পক্ষের আইনজীবি আব্দুর রাজ্জাক রিভিউ শুনানীতে বলেন, “মোমেনার সাক্ষ্যে (যে সাক্ষ্যে আপিল বিভাগ ফাঁসির রায় দেয়) অসঙ্গতি রয়েছে। তিনি একেক জায়গায় একেক রকম বক্তব্য দিয়েছেন।… বক্তব্যে অসঙ্গতি থাকলে সাক্ষী বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। বিশ্বাসযোগ্যতা না থাকলে সেই সাক্ষীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেয়া যায় না।” বিচারপতি এসকে সিনহা এ সময় বলেন, “সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা আছে বলেই আমরা গ্রহণ করে শাস্তি দিয়েছি।” এরপর ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “আপিলের রায়ে ত্রুটি রয়েছে। তার প্রমাণ হচ্ছে বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা ওই সাক্ষীকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি বলে তিনি তার রায়ে সাক্ষীর অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেন।”এ পর্যায়ে বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা বলেন, “সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় হয়েছে। যাতে চারজন একমত হয়েছেন। সেখানে আমারটা বলা আমার জন্য বিব্রতকর। সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতামতই প্রাধান্য পাবে। আমার মতের কথা বলা হলে আমি বিব্রতবোধ করব।”
এরপর ব্যারিস্টার রাজ্জাক বিষয়টি এড়িয়ে যান এবং ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার’ বিষয়ে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ তুলে ধরেন। আপনি এই বক্তব্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। আপনি বলেছেন
“পত্রিকায় দেখা গেছে, রিভিউ আবেদনের বিষয়ে সুপারসনিক গতিতে শুনানি চলাকালে আবদুল কাদের মোল্লার আইনজীবী বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। তার জবাবে দুজন বিচারপতি শুধু বললেন, আমরা বিশ্বাস করেছি বলেই ফাঁসি দিয়েছি। যে দুজন এ কথা বলেছেন, তাদের প্রতিই আবদুল কাদের মোল্লা ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা জানিয়ে অনাস্থা দিয়েছিলেন। কেন শুধু একটি বক্তব্য বিশ্বাস করলেন এবং বাকি দুটি বক্তব্য বিশ্বাস করলেন না—সেটার কোনো বিস্তারিত আমরা দেখতে পেলাম না”
আপনি আসলে বার বার নিজেকে ইচ্ছে করেই নির্বোধ প্রমাণ করবার মিশনে নেমেছেন কিনা আমি জানিনা [যদিও আপনি মন্তব্যে নিজেকে নির্বোধ দাবী করেছেন] আপনার কি ধারনা এই রিভিউ এর মত স্বল্প পরিসরে সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে বিশ্লেষন হবে যেখানে ৭৯০ পৃষ্ঠার রায় এই বিচারপতিরাই লিখেছেন মাত্র সপ্তাহ খানিক আগে? আপীলেট ডিভিশানে যখন আপীলের জন্য মামলা যায় সেখানেই কোর লিগাল পয়েন্ট ছাড়া আর অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনার সুযোগ নেই আর সে যায়গায় রিভিউ আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই একই কথা আবার বলবে বলে আপনি প্রত্যাশা করছেন। আপনি ভাই পারেনও। বিচারপতিরা সাক্ষী মোমেনাকে নিয়ে যা বলবার সেটি তাদের ৭৯০ পৃষ্ঠার রায়েই বলেছে। রাজ্জাক রিভিউ তে ঐ ব্যাপারে নতুন কোনো তথ্য কিংবা যুক্তি তো দিতে পারেন নি বরং তিনি আগের ডিসিশানকেই পুনঃর্বিবেচনা করতে বলেছেন। তাহলে রিভিউ করতে পারবে কি পারবে না এই ব্যাপারে সাধারণ আবেদনের শুনানীতে কেন বিস্তারিত আলোচনা হবে?
আসুন দেখি আপীলেট ডিভিশান কি বলছে এই সাক্ষ্য নিয়ে। কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত মোমেনার সাক্ষ্য গ্রহন করেছে?
Although only one witness, P.W.3, was put forward to establish this charge, her testimony was really unimpeachable, she was not only an eye witness but a direct victim of inexonerable avagery that made 1971 a blotted year for the whole world.having scrunised the record with required precision, we are of the view that the judgment of the Tribunal would not have been different if P.W.3 would have replied in the negative to all of the proposed questions and hence we do not reckon that interest of justice has suffered any affliction.[ আপীলেট ডিভিশান রায়, পৃষ্ঠা ৭৪৫]
আসামী পক্ষ সাক্ষীর ক্রস এক্সামের সময় প্রশ্ন করতে ভুলে গেছে। এটাও এখন ট্রাইবুনালের দোষ। আসামী পক্ষের আইনজীবিরা প্রশ্ন করবে না সময় মত কিন্তু পরে গিয়ে বলে, আমরা কিছু প্রশ্ন করতে ভুলে গেছি। আমাদের আবারো প্রশ্ন করবার সুযোগ দেয়া হোক। যখন এই কথা তারা বলেছে তখন অলরেডী আরো অনেক প্রসিকিউশনের সাক্ষীর ক্রস এক্সাম করা শেষ। ট্রাইবুনালটা যেন কাদের মোল্লার আর তার আইনজীবিদের মামার বাড়ীর আবদারের একটা পীঠস্থান।
এই বিষয়ে আদালত বলে-
Mr. Razzak submitted that the Appellant’s learned Advocate that was initially engaged failed to put some pertinent questions to this witness of the prosecution and thus, she should now be made available to reply to those missed out questions in the interest of justice. Mr. Razzak tended to place paramount reliance on the ratio of the UK Court of Appeals’ decision in the case of Birmingham Six (1991 Cr. Appeal Review, Page 287), but we find no element in the case in hand to relate the same with the decision in Birmingham Six case, which, succinctly is that if new evidence surfaces after a trial or even appellate procedure is concluded, a trial de-novo can nevertheless be re-commenced. [আপীলেট ডিভিশান রায়, পৃষ্ঠা ৭৪৫, ৭৪৬]
He also complained that Quader Molla’s name is not figured in Jallad Khana documents. Admittedly these claimed documents were never adduced as evidence and never formed part of the proceeding. I can not accept as evidence some unauthenticated photocopies, which were never proved. I do not know what they are whence they came, who made them. These are obscure photocopies of some papers from unidentified source. [আপীলেট ডিভিশান রায়, পৃষ্ঠা ৭৪৭]
আবার জল্লাদ খানার এই জবানবন্দীর কথা আসামী পক্ষ ২০১২ সালের ১৭-ই অক্টোবর জানতে পারলেও তারা এই ব্যাপারে আবেদন কয়রে ৮-ই জানুয়ারী ২০১৩ [ প্রশ্ন দাঁড়ায়ঃ এই আবেদন করতে ৩ মাস কেন লেগেছে? ভুয়া কাগজ তৈরী করতে?]
আদালত এই বিষয়ে বলেন-
To coagulate the Tribunal’s view, we would add that the Appellant and / or his learned Advocates came to know of Jallad Khana records at the latest on 17th October 2012, the date on which P.W. 11’s examination was concluded, because that witnesses explicitly stated that she picked up information from the Mirpur Jallad Khana on some P.Ws. yet they remained mum for nearly three months before filing the subject application. This inordinate delay is inexplicable and can quite sensibly be looked at as a delaying device, given that the defence filed numerous unmeritorious applications during the trial that subsisted for a year after the assumption of cognizance.
একটা কথা বুঝতে হবে যে, এটাই এই মামলায় স্বাভাবিক যে কাদের মোল্লার মত এতবড় একটা খুনী এলিবাই [ঘটনার সময় অভিযুক্তের অনুপস্থিতি] ডিফেন্স দিবে। সে তো বলবেই যে ঘটনার সময় সেই ছিলোই না ঘটনাস্থলে। এই কাদের মোল্লার সবচাইতে বড় ইয়ার দোস্তো আক্তার গুন্ডা ছিলো কাদের মোল্লার মত এমন এক ভয়াবহ খুনী। কাদের মোল্লা, আক্তার গুন্ডা এরা মিলেই মূলত ১৯৭১ সালে মিরপুরে হত্যাযজ্ঞ চালায়। ১৯৭২ সালে দালাল আইনে এই আক্তার গুন্ডার বিচার হয় এবং বিচারে তার ফাঁসীও হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই রায় থেকেই দেখতে পেলাম এই আক্তার গুন্ডাও আজ থেকে ৪০ বছর আগে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ডিফেন্ড করতে গিয়ে সেই একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলো। সেই এলিবাই ডিফেন্স, আজ যেটি কাদের মোল্লা করেছে।
আক্তার গুন্ডার এলিবাই ডিফেন্সের একটি চিত্র। মূল রায় থেকেঃ [সূত্রঃ ২৫ ডি এল আর, পৃষ্ঠাঃ ৪৪৫]
কাদের মোল্লার মামলার রায়টি আপনারা পড়ে দেখলে দেখবেন সাক্ষীরা অসংখ্যবার কাদের মোল্লার সাথে সাথে আক্তার গুন্ডা, নেহাল, হাক্কা গুন্ডার কথাও বলেছে। তারা সবাই সরাসরি কাদের মোল্লাকে নিজ চোখে শনাক্ত করে, দেখে আদালতকে নিশ্চিত করেছে যে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ব্যাক্তিটিই সেই কুখ্যাত কাদের মোল্লা। লক্ষ্য করে দেখুন, ৪১ বছর আগে আক্তার গুন্ডাও তার বিচার চলাকালে বলেছিলো যে, সেইসময় সে পাকিস্তানে বেড়াতে গিয়েছিলো। হত্যাকান্ডের কথা কিছু সে জানেই না। আবার ৪১ বছর পর আসামী কাদের মোল্লাও বলেছিলো যে, ঘটনার সময় সে ফরিদপুরে ছিলো এবং সে এই হত্যাকান্ডের, গণহত্যার কিছুই জানে না। অবস্থা দৃষ্টিতে আসলে মনে হয়, এই গণহত্যা, এই নৃশংসতা আসলে ভূত এসে করে দিয়ে গিয়েছে। ভারতীয় ঐ সিনেমাটির মত, এত মানুষের সামনে জেসিকাকে খুন করবার পরেও প্রমাণ নেই কিংবা কেউ ভয়ে সাক্ষ্য দিতে আসে না। অবস্থা দৃষ্টিতে এক পর্যায়ে মনেই হয়েছিলো, জেসিকাকে কেউ খুন করেনি। চলচ্চিত্রটির নাম ছিলো “নো ওয়ান কিল্ড, জেসিকা”
কাদের মোল্লা নাকি মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছিলো। কি ভয়াবহ তথ্য!! অথচ এই ব্যাপারে তার হয়ে যেসব গাঁট কাটাল বন্ধুরা এসেছিলো সাক্ষী দিতে তারা বলতেই পারেনি কোনো তথ্য। একজন আবার বলেছে যে কাদের মোল্লা নাকি ফরিদপুরে এক বছর ধরে ব্যাবসা করেছে। অথচ কাদের মোল্লা নিজেও তা দাবী করেনি। কি ভয়াবহ!!! মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে জামাতীরা বার বার প্রোপাগান্ডা ছড়ায় যে এই মামলায় প্রসিকিউশনের সাক্ষীরা সব শোনা কথা বলছে কিংবা শোনা কথায় সাক্ষী দিচ্ছে, আপনাদের জেনে রাখা ভালো যে কাদের মোল্লার পক্ষে যারা সাক্ষী দিতে এসেছে তারাও বেশীর ভাগ শোনা বা হিয়ার্সি সাক্ষ্য।
আদালত বলেন-
The Appellant quite emphatically stated that he was the private secretary to Mr.Golam Azam, the then head of Jamate Islam, he was head of the Shahidulla Hall unit of Islami Student Organisation, the student organisation, which was Jamate Islami’s ideological apostle, and acted in accordance with Jamats’ sermons. Assertion by a number of P.Ws that Mr. Golam Azam was a candidate for Parliamentary election that took place in 1970, as a Jamat nominee, has never been disputed by the defence side. It is only natural that as Mr. Golam Azam’s private secretary and Jamat’s ideological follower, he would have devoted a great deal of time to campaign for Mr. Golam Azam, yet the Appellant did not utter a word about Mr. Golam Azam’s 1970 election though he gave vivid description of what he claims to have been doing in 1970, which makes his deposition doubtful. Secondly, in the light of the appellant’s admitted background it is inconceivable that the Appellant would have had taken armed training to liberate Bangladesh from Pakistani suzerienty.
While truth will face casualty if it is stated omnibus that all the activists of Jamat and its ffshoots resorted to killing, raping etc. and while reality dictates that some members of Jamat parted company with Jamat’s stance particularly after the Pak army’s crackdown, the stark truth is that Jamat as a political party conceptually and incessantly remained loyal to Pak army, opposed to Liberation War and took a firm position to stand by the idea of united Pakistan and interruptedly kept helping Pak army throughout the War period,in their effort to foil the Liberation War.
Appellant’s subsequent activities such as his continuation as a Jamat high up after it re emerged as a political party in 1979 proves that he did not deviate from Jamat’s philosophy and therefore his claim to have had taken armed training to fight Pak army to Liberate Bangladesh is simply absurd and devoid of any credibility whatsoever. This patently concocted claim goes to tarnish the very root of his credit rating as a witness.
Having compared the testimonies of D.Ws 1, 2, 3 and 6, all of whom basically tried to prove the Appellant’s alibi, I have detected catastrohic discrepancies, capable of rendering their version to nullity. The appellant himself said that he ran the business at the market place at his village home upto the end of 1972, whereas D.W. 3 asserted that the Appellant was in the business for a total period of one year, which means upto March 72. While the Appellant insisted that he returned to the hall to take the practical exms in July 71 for a period, which on calculation appears to have been in excess of 4 weeks, D.W. 6, who affirmed that he stayed back in the hall and performed as the Imam of the Hall’s mosque, stated that the Appellant remained in the village all through the period and that he next saw the Appellant only at the end of 1972. D.W. 2 and D.W. 3 also said that they kept seeing the Appellant in his business venue in the market place throughout the period i.e. without intermission. There are yet two other plausible reasons why I find the alibi evidence incredible.
অথচ এই মুক্তিযোদ্ধা দাবী করা কাদের মোল্লাই দাবী করে যে, মুক্তিযোদ্ধারা নাকি টাকা, অর্থ আর সম্পত্তির লোভে যুদ্ধে গিয়েছিলো কিংবা সে আরো বলে, বাংলাদেশ হওয়াতে নাকি সাংবাদিকদের মাতব্বরি বেড়ে গেছে। তাহলে আমার প্রশ্ন থাকলো এই কাদের মোল্লার কাছেই যে, কাদের মোল্লা যে নিজেকে দাবী করেছে সে মুক্তিযুদ্ধে গেছে, তবে সে কিসের লোভে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে? আজ তাহলে পাকিস্তানের মন্ত্রী, আমলারা দাবী করছে যে সে, পাকিস্তানের প্রতি আমৃত্যু লয়েল ছিলো? এটা কোন প্রজাতীর মুক্তিযোদ্ধা?
আবার, এতই স্বতী-স্বাধ্বী আমাদের কাদের মোল্লা যে তাকেও সাক্ষী জালিয়াতি করতে হয়েছিলো। আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনীত প্রথম অভিযোগ মিরপুর বাঙলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যা মামলায় এই কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল পল্লবের ভাইয়ের স্ত্রী মোসাম্মৎ সাহেরাকে তার বাবার [কাদের মোল্লা] পক্ষে সাক্ষী দেবার জন্য রাজী করায়।[ডিফেন্স সাক্ষী নাম্বার-৪] আরো ইন্টারেস্টিং তথ্য হচ্ছে, ডিফেন্সের এই সাক্ষী মোসাম্মৎ সাহেরা প্রথমে ছিলো প্রসিকিউশনের সাক্ষী, অর্থ্যাৎ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সাক্ষী। কিন্তু এই সাহেরাই আবার পরে কাদের মোল্লার পক্ষে সাক্ষী দেয়। আদালতে মোসাম্মৎ সাহেরা হাতে নাতে ধরা খেয়ে যায় মিথ্যে কথা বলতে গিয়ে। [ ট্রাইবুনালের রায়ের প্যারা ১৮২-১৮৯ দ্রষ্টব্য]
লক্ষ্য করে দেখুন একটা ব্যাপার। রাষ্ট্র পক্ষের যেসব সাক্ষী পরবর্তীতে টাকা খেয়ে আসামীদের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে গিয়েছে তারা দুইবার দুই রকম কথা বলেছে। ইনভেস্টিগেশন অফিসারদের কাছে তারা প্রথমে দিয়েছে আসামীদের বিরুদ্ধে জবানবন্দী আর পরে আসামীদের পক্ষে বলতে গিয়ে দিয়েছে তাদের পক্ষে সাক্ষ্য। তাহলে একই লোক দুই রকমের কথা বলছে। অথচ প্রসিকিউশনের সাক্ষী মোমেনা বেগম, যিনি আদালতে কাদের মোল্লাকে দেখে হাত উঠিয়ে বলেছে যে এই লোকই খুন করেছে তার বাবাকে, মাকে, এই লোককেই সাক্ষী দেখেছিলো সেদিন। এই লোকই তার দুই বছরের ভাইকে আছাড় দিয়ে হত্যা করেছে, তিন বছরের বোনকে ধর্ষন করেছে। ইনফ্যাক্ট আদালতে দাঁড়িয়ে মোমেনা চিৎকার করে কাদের মোল্লাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, “আমার বাবাকে ফিরিয়ে দে”
সাফি সাহেব আবার বলেছেন, যে মোমেনা নাকি ইনভেস্টিগেশন কর্মকর্তাকে ভিন্ন সাক্ষ্য দিয়েছে। আপনার এই বক্তব্য সম্পূর্ণ রকমের ভুল ও মিথ্যা তথ্য। আপনাকে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, ইনভেস্টিগেশন কর্মকর্তার যে ডায়েরী (যেখানে ইনভেস্টিগেশন কর্মকর্তা তদন্তের সময় নানান তথ্য টুকে রাখেন) রেফার করে আসামী পক্ষের আইনজীবি তার বক্তব্য দিয়েছেন সেটা সাক্ষ্য আইনে আমলের যোগ্য নয়। কেননা, আইন অনুযায়ী ইনভেস্টিগেশন কর্মকর্তার এই টুকে নেয়া টাইপ তথ্য বা বক্তব্য আদালত নিতে পারেনা। সাক্ষী নিজেও এই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন বলে আদালতে খনই বলেন নি। সুতরাং ইনভেস্টিগেশন অফিসারকে কাদের মোল্লার ব্যাপারে অভিযোগ করেন নি কিংবা কাদের মোল্লা অভিযুক্ত নয়, এই জাতীয় কথা মোমেনা বলেন নি বলেই আমরা আদালতের রায়ে দেখতে পাই।
আপনি আবার বলেছেন,
“এদিকে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আবদুল কাদের মোল্লার পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি জানানো হয় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হওয়া মোমেনা বেগম এবং হযরত আলী লস্করের মেয়ে মোমেনা এক নন। বোরকা ও নেকাবে মুখ আবৃত ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হওয়া মোমেনাকে নিয়ে উত্থাপিত এ প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই। সরকার, প্রসিকিউশন সবাই নীরব”
এটা হাস্যকর দাবী। অনেকটা সাঈদীকে চান্দে দেখা যাবার মত দাবী। বাঁশের কেল্লায় একটা ছবি দেখানো হচ্ছে এমন যে, একদিকে মোমেনা বেগমের ছবি আবার অন্যদিকে প্রসিকিউটর মুক্তা আপার হাতে ধরা কালো বোরকায় পরা একজন ভদ্রমহিলার হাত ধরা। আমি যদি ধরেও নেই যে এই সাক্ষী মোমেনা, তাতে করে কি প্রমাণিত হয়? এতে করে কি প্রমাণিত হয় যে এই সাক্ষীই মোমেনা নয়? এই ধরনের কোনো দাবী আপীলেট ডিভিশানে আসামী পক্ষের আইনজীবি আব্দুর রাজ্জাক করেন নি, খন্দকার মাহবুব করেন নি। কেন করেন নি? আর আসামী পক্ষ যদি দাবী করেই থাকে যে এই মোমেনা সেই মোমেনা নয়, তবে সেই ফ্যাক্ট প্রমাণ করবার দায়িত্ব আসামী পক্ষের আইনজীবিদের। এই দায় প্রসিকিউশনের কি করে হতে পারে?
আর মোমেনা তাঁর পরিচয় কিংবা চেহারা শুধু মাত্র দেখাবেন সুনির্দিষ্ট কয়েকজনকে, গোপনে। এটাই ক্যামেরা ট্রায়ালে যাবার তাঁর কারন। সেই হিসেবে মোমেনাকে দেখেছেন আসামী পক্ষের আইনজীবি, মাননীয় বিচারপতিরা, প্রসিকিউশনের আইনজীবিরা। এই নিরাপত্তা নিতে পারার এই প্রভিশন আইনে রয়েছে প্লাস সাক্ষীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে এমন সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারও তাঁর রয়েছে। সাক্ষী যদি মনে করেন যে তিনি গোপনে সাক্ষ্য দিবেন আইন অনুযায়ী তাতে আপনার সমস্যা কোথায়? জামাতী খুনীদের কাপুরুষোচিত খুন-খারাপির কথা, তাদের নৃশংসতার কথা চিন্তা করে এই সাবধান মূলক ব্যাবস্থা একজন সুস্থ মানুষ নিতেই পারেন আইন অনুযায়ী। এই মামলায় মোমেনা বেগম নয়, অনেক সাক্ষীই ক্যামেরা ট্রায়ালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আর এই ধরনের সাক্ষ্যের ব্যাপার পৃথিবীর প্রত্যেক্টি দেশে এই জাতীয় ট্রায়ালের ক্ষেত্রে প্রচলিত রয়েছে।
বাঁশেরকেল্লা যা করেছে কিংবা আপনারা মোমেনার নেকাব খুলে তাঁকে দেখতে চাওয়ার যে ম্যাৎকার করছেন সেখানে একধরনের পৈশাচিকতা রয়েছে। যেই মানুষটি তাঁর পরিবারের প্রত্যেককে নৃশংসভাবে খুন হতে দেখেছে, যেই ব্যাক্তি গত ৪২ টি বছর ট্রমাটাইজড ছিলো, কাতর ছিলো, আপনারা একটা খুনীকে বাঁচাবার জন্য তাঁর নেয়া নিরাপত্তাকেও উপহাস করছেন। আগেও জামায়াত জল্লাদের দল ছিলো। স্বাধীনতার এত বছর পর আপনারা আজও বদলাননি। একটা খুনীকে বাঁচাবার জন্য আপনাদের কূট কৌশল আর গোয়েবলসীয় মিথ্যাচার এতই প্রকট যে, গোয়েবল এসেও এখানে মূর্ছা যাবে।
আপনি আবার বলেছেন,
“আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরও হয়েছে সুপারসনিক গতিতে। এক্ষেত্রে জেল কোডের কোনো কিছুই অনুসরণ করা হয়নি। জেল কোড অনুযায়ী মৃত্যু পরোয়ানা জারির পর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার জন্য ৭ দিন সময় থাকে। সে সময়টি পর্যন্তও দেয়া হয়নি আবদুল কাদের মোল্লাকে। জেল কোডের আরেকটি বিধান হলো মৃত্যু পরোয়ানা জারির ২১ দিন আগে নয় এবং ২৮ দিন পর নয়—এমন সময়ের মধ্যে দণ্ড কার্যকর হবে। আবদুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে সেটাও মানা হয়নি”
আপনি একটা দূর্দান্ত মিথ্যেবাদীর মত মিথ্যে তথ্য দিলেন। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস এক্ট-১৯৭৩ এর ২০ ধারার সাব ধারা ৩ অনুযায়ী এই রায় এক্সিকিউট করবে সরকার। এখানে কারাবিধি মানবার কোনো সুযোগ নেই। আপনি এই কথা এড়িয়ে গিয়ে কারাবিধির বুলি কপচালেন। এই আইন এক্সিকিউট সরকার করবে তার ইচ্ছে অনুযায়ী। এখানে কারাবিধি অনুযায়ী টাইম ফ্রেম ধরে মানবার বাধ্যবাধকতা কোথায়। আমাকে কি দেখাতে পারবেন?
আপনি বলেছেন-
“বাংলাদেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় দায়রা আদালতে মৃত্যুদণ্ড হলে হাইকোর্ট বিভাগে পর্যালোচনা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া দণ্ড কার্যকরের কোনো সুযোগ নেই। হাইকোর্ট বিভাগে দণ্ড বহাল থাকলে আপিল বিভাগে যাওয়ার সুযোগ থাকে। আপিল বিভাগে বহাল থাকলে রায় প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন দায়েরের সুযোগ পাওয়া যায়। রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তির পর মৃত্যু পরোয়ানা জারি হয়। এতগুলো স্তর অতিক্রমের উদ্দেশ্য হলো চূড়ান্ত দণ্ড কার্যকরের আগে বার বার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সন্দেহের ঊর্ধ্বে ওঠা। আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ড হয়েছে আপিল বিভাগে। আর কোনো উচ্চতর জায়গা নেই সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা প্রতিকার চাওয়ার। শেষ পর্যন্ত রিভিউ করারও সুযোগ হয়নি”
প্রথমত, এই বিচার দায়রা আদলতে হয়নি। হয়েছে স্পেশাল আইনে। যে আইনের একটি নিজস্ব রুলস এন্ড রেগুলেশনও রয়েছে। এটি সম্পূর্ণভাবে একটি স্বাতন্ত্র আইন এবং এই বিচারের রায় হাইকোর্টে না, আপীলের জন্য সরাসরি আপীলেট ডিভিশানে যাবে। আইনে তাই লেখা রয়েছে। আর রিভিঊ এর কথা যা বলেছেন সেটিও আপনি ভুল বলছেন। এই বিষয়ে বিশিষ্ট আইনবিদ ও সাংবাদিক একরামুল হক শামীমের এই বিষয়ক
একটি লেখা এখানে কোট করি-
প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক, রিভিউ’র অধিকার কীভাবে এসেছে। সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে রিভিউর কথা বলা আছে।
সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী – ‘সংসদের যে কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে এবং আপীল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যে কোন বিধি-সাপেক্ষে আপীল বিভাগের কোন ঘোষিত রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকিবে।’
এই অনুচ্ছেদটির দিকে লক্ষ্য করলে এটি স্পষ্ট হবে যে রিভিউ ‘পরম অধিকার’ (absolute right) নয়। ২টি সুনিদিষ্ট
শর্ত সাপেক্ষে এই অধিকার পাওয়া যাবে।
১.সংসদের যে কোনো আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে
২.আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যে কোনো বিধি সাপেক্ষে
কারও রিভিউর অধিকার রয়েছে এটি বলার আগে অবশ্যই এই দুইটি শর্ত পূরণ হচ্ছে কিনা তা বিচার করতে হবে। দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করেছি, বেশ কয়েকজন আইনজ্ঞ এই শর্তের ব্যাপারটি এড়িয়ে গিয়ে রিভিউকে ‘পরম সাংবিধানিক অধিকার’ হিসেবে দেখিয়েছেন। এর মানে যে কোনো পরিস্থিতিতেই রিভিউর অধিকার পাওয়া যাবে। কিন্তু ১০৫ অনুচ্ছেদের ২টি শর্ত ভিন্ন কথা বলে। ১০৫ অনুচ্ছেদে শর্ত দুইটির ব্যাখ্যা করা যাক।
প্রথম শর্ত : সংসদের যে কোনো আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে
সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদের প্রথম শর্তই হলো সংসদের যে কোনো আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রিভিউ করা যাবে। জাতীয় সংসদে ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই পাশ হওয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের বিধান এক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে। এই আইনের ২১ ধারায় আপিলের অধিকার দেওয়া হয়েছে। রিভিউ’র ব্যাপারে এই আইনে কোনো বিধানের উল্লেখ নেই। আইনে অনেক বিষয়ই উল্লেখ থাকে না। উল্লেখ থাকে না বলে তা নীরব অবস্থায় আছে এমনটা ধরে নেওয়া ঠিক না। সেক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়া হবে অভিযুক্ত অপিরাধীরা, ভিকটিমের স্বার্থ সেখানে ক্ষুণ্ন হবে। একজন আইনজ্ঞ বলেছেন, যেহেতু ট্রাইব্যুনালের আইনে রিভিউর ব্যাপারে কিছু উল্লেখ নেই, তাই রিভিউ করার ব্যাপারে বাধাও নেই। এ এক আজব যুক্তি। যেখানে রিভিউ করার বিধানই নেই,সেখানে করার ব্যাপারে বাধার প্রসঙ্গ আসে কীভাবে?
১৯৭৩ সালের ট্রাইব্যুনাল আইনের ২১ ধারার আপিলের বিধানের সঙ্গে রিভিউ’র অধিকার অবিচ্ছেদ্য নয়। লক্ষ্য রাখতে হবে সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদের অধীনে থাকা আপিলের বিধান অনুযায়ী কাদের মোল্লা আপিল বিভাগে আপিল করেনি। ১৯৭৩ সালের আইনে কোন প্রেক্ষাপটে আপিলের সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা বুঝতে সহায়তা করবে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য উত্থাপিত বিলের উপর তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধরের ভাষণ। জাতীয় সংসদে তিনি যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন –
‘তারা যদি দোষী সাব্যস্ত হয় এবং বিচারে দণ্ডিত হয়, সেই দণ্ডের বিরুদ্ধে তারা আপিল করতে পারবে- আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীম কোর্টে। কাজেই এটা কম কথা নয়। যে জাতি এতটা দুর্ভোগে ভুগলো, ঐতিহাসিক নজিরবিহীন অত্যাচারের শিকার হলো, এতোসব জ্বালা-যন্ত্রণা ভোগার পরও যাতে ঐসব নরপিশাচের ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত হয়, আইনের মাধ্যমে আমরা তার ব্যবস্থা করেছি।’
মনোরঞ্জন ধর তার বক্তব্যের কোথাও রিভিউ সুবিধা নিয়ে আলোচনা করেননি। বরংচ যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রে আপিলের অধিকার দেওয়া হবে কিনা তা নিয়ে তখন বিতর্ক হয়েছিল।
সংবিধানের কোথাও উল্লেখ নেই যে, রিভিউ আপিলের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য অধিকার। বরংচ ১০৫ অনুচ্ছেদের ১ম শর্ত বলে, এটি সংসদের আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে নির্ধারিত হবে।
দ্বিতীয় শর্ত – আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যে কোনো বিধি সাপেক্ষে
দ্য সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ (আপিল বিভাগ) রুলস ১৯৮৮ এর অর্ডার ২৬, রুল ১ এ রিভিউ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। এই রুল অনুযায়ী-
Subject to the law and the practice of the Court, the Court may, either of its own motion or on the application of a party to a proceeding, review its judgment or order in a Civil proceeding on grounds similar to those mentioned in Order XLVII, rule 1 of the ‘Code of Civil Procedure and in a Criminal proceeding on the ground of an error apparent on the face of the record.
এক্ষেত্রেও যে পরম অধিকার নেই তা দুটি শর্ত থেকেই স্পষ্ট হয়। শর্ত দুটি হলো-
১. আইন সাপেক্ষে (Subject to the law)
২. কোর্টের চর্চা সাপেক্ষে (the practice of the Court)
প্রথম শর্তের কথা বলতে গেলে আবার প্রাসঙ্গিকভাবে ১৯৭৩ সালের ট্রাইব্যুনাল আইনের কথা চলে আসে। এই আইনে রিভিউ’র প্রসঙ্গ উল্লেখ নেই।
দ্বিতীয় শর্তে কোর্টের প্র্যাকটিসের কথা বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে মাহমুদুল ইসলাম তার কন্সটিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ বইয়ে লিখেছেন –
‘As the review jurisdiction has been made subject to the practice of the court and the court was reluctant to exercise the jurisdiction except in case of substantial injustice, in seeking review, it is not sufficient to bring the case within the fold of rule 1 of Order XLVII of the Code; it has to be shown that unless the judgment is reviewed a substantial injustice would be done.’ (পৃষ্ঠা ৬৪১)
মাহমুদুল ইসলামের এই বক্তব্য থেকেই এটি স্পষ্ট যে রিভিউ জুরিসডিকশন কোর্টের চর্চার উপরনির্ভর করে এবং কোর্ট তা করতে খুব বেশি আগ্রহী থাকে না। বড় রকমের অবিচার হবে মনে হলেই রিভিউ জুরিসডিকশন ব্যবহৃত হয়। ফলে এটি খুব স্পষ্টভাবেই বলা যায়, রিভিউ করার অধিকার একটি সাংবিধানিক অধিকার হলেও এটি কোনো ‘পরম সাংবিধানিক অধিকার’ নয়। বেশ কিছু শর্তপূরণ সাপেক্ষে এই অধিকারের চর্চা করা হয়।
মাহমুদুল ইসলামের বইয়ে বেশ কিছু মামলার রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় তা উল্লেখ করা হলো-
1. The Review jurisdiction cannot be utilized for re-hearing of the matter. [Zobaida Nahar v. Khairunnessa, 3 BLC (AD) 170; Idris Ali v. Enamul Huq, 43 DLR (AD) 12; Nurul Hossain v. Bangladesh,1 BLC (AD) 219]
2. A decision of the court should be re-opened with the very greatest hesitation and only in a very exceptional circumstance. [Akbar Ali v. Iftekhar Ali, PLD 1956 FC 50; Lily Thomas v. India, AIR 2000 SC 1650 (Power of review is not to be exercised to substitute a view)]
3. A wrong decision on interpretation of certain provisions of law or principle laid down in a decision relied upon by the court is no ground for review. [Zenith Packages v. Labour Appellate Tribunal, 52 DLR (AD) 160]
4. Review will not be allowed on a new ground which was not urged in the appeal. [Bangladesh Bank v. Abdul Mannan, 46 DLR (AD) 1,7]
5. The judgment delivered by the court will not be disturbed except where glaring omission or patent mistake or grave error apparent on the face of the record has crept in the earlier decision by judicial fallibility. [Northern India Caterers v. Governor, AIR 1980 SC 674, 678; G.M.Jamuna Oil Co. Ltd v. Chairman, Labour Court, 2000 BLD (AD) 240]
এই মামলাগুলোর সিদ্ধান্ত পর্যবেক্ষণ করলে এটি স্পষ্ট হবে যে রিভিউ ‘পরম সাংবিধানিক অধিকার’ নয়। সুপ্রিম কোর্টের (আপিল বিভাগের) বিধিতেও বলা হয়েছে ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে ‘on the ground of an error apparent on the face of the record’ শর্তে রিভিউ করা যাবে। ফলে যারা একে অবিচ্ছেদ্য অংশ কিংবা পরম সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে দেখাতে চাচ্ছেন তারা নিশ্চিতভাবে কিছু তথ্যকে লুকাচ্ছেন।
সংবিধানে ৪৭ক(২) অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গ
সংবিধানের ৪৭ক(২) অনুচ্ছেদে রয়েছে-
‘এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযোজ্য হয়, এই সংবিধানের অধীন কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবে না।’
সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আইন হচ্ছে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন। যেহেতু কাদের মোল্লার মামলা ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে হয়েছে সুতরাং সংবিধানের ৪৭ক(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিনি ১০৫ অনুচ্ছেদের জন্য প্রতিকারের জন্য আবেদন করতে পারবেন না। ব্যারিস্টার আমীরউল ইসলাম এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত। কিন্তু সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের মনে হচ্ছে ৪৭ক(২) অনুচ্ছেদের বাধা ১০৫ অনুচ্ছেদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। তিনি মনে হওয়ার ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্তে পৌছেছেন। পাশাপাশি তিনি লিখেছেন, যেহেতু রিভিউ সাংবিধানিক অধিকার, তাই এই অধিকার দিতে হবে। কিন্তু তিনি সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদের শর্তগুলোর কথা বললেন না। এমনকি সুপ্রিম কোর্ট (আপিল বিভাগ) বিধিমালার আদেশ ২৬, বিধি ১ এর শর্তগুলোর কথাও বললেন না।
সংবিধানের প্রথম সংশোধনী অর্থাৎ ৪৭ক অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার পক্ষে রিট করা হয়েছিল। বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা ও বিচারপতি কাজী রেজাউল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের বেঞ্চে এর শুনানি হয়। ১৭ আগস্ট থেকে শুনানি শুরু হয়। যারা গণহত্যা করেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের ক্ষেত্রে মানবাধিকার ও সংবিধানের মৌলিক অধিকার প্রযোজ্য কি না- শুনানিতে সে প্রশ্ন তুলেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, মনে রাখতে হবে, এটা আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের অংশ। আদালত আরও বলেন, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধসহ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচারের জন্য সংবিধানে মৌলিক মানবাধিকার স্থগিতের কথা বলা হয়েছে। যারা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের জন্য এ আইন। এটা সাধারণ নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য নয়।
পরবর্তীতে ২৩ আগস্ট রিট আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক রিট আবেদনটি ফেরত নেওয়ার আবেদন জানায়। এর কারণ অজানা থেকে যায়। আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা ও বিচারপতি কাজী রেজাউল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রিটটি উপস্থাপন করা হয়নি বিবেচনায় খারিজ করে দেন। আজকের প্রেক্ষাপটে, রিটের শুনানিকালে হাইকোর্ট বিভাগের সেই পর্যবেক্ষণ আবারও সামনে আনা উচিত – ‘গণহত্যা ও মানবতা বিরোধী অপরাধসহ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচারের জন্য সংবিধানে মৌলিক মানবাধিকার স্থগিতের কথা বলা হয়েছে। যারা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, তাদের জন্য এ আইন। এটা সাধারণ নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য নয়।’
আপনি এই রিভিঊ নিয়ে বলবার পর বলেছেন-
“আইনে প্রাপ্য সুযোগ থেকে আবদুল কাদের মোল্লা বঞ্চিত হলেও মানুষের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হননি। ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ উত্সর্গকারী আবদুল কাদের মোল্লাকে রাতের আঁধারে সরকারি নিয়ন্ত্রণে দাফন করা হলেও তার গ্রামের মানুষ ঠিকই দিনের বেলায় জুমার নামাজের পর গায়েবানা জানাজার মাধ্যমে তার মাগফিরাতের ফরিয়াদ জানিয়েছেন আল্লাহর দরবারে। শুধু তার গ্রাম নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে আবদুল কাদের মোল্লার জন্য। নিজ দেশের মানচিত্রের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশের বাইরেও আবদুল কাদের মোল্লার জন্য বিশ্বের দেশে দেশে হাজারো মুসলমান গায়েবানা জানাজা আদায় করেছেন। সরকার বঞ্চিত করার চেষ্টা করলেও দুনিয়াজুড়ে মুসলমানের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা নিয়ে আবদুল কাদের মোল্লা আখেরাতের পথযাত্রী হয়েছেন। এটাই মোমেনের জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্য”