বাংলাদেশে বর্তমানে চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য গঠিত ট্রাইবুনালটি কি আন্তর্জাতিক কি না এইটি নিয়ে আমি আজ পর্যন্ত কয়েকশ বার উত্তর দিয়েছি। অনেকেই মনে করছেন যেহেতু ট্রাইবুনালের সাথে আন্তর্জাতিক শব্দটি জড়িত, তাহলে কেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে বিচারপতি এই ট্রাইবুনালে আনা হচ্ছে না, কেন বিদেশী আইনজীবি নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না ইত্যাদি নানাবিধ প্রশ্ন।
এই ব্যাপারটি নিয়ে অনেক মানুষ খানিকটা কনফিউজড সেটি আমি বুঝি। এই কনফিউজড হবার কারন হচ্ছে যারা এই ট্রাইবুনালটি চায় না, অর্থ্যাৎ জামাত ও তাদের দোসররা ইচ্ছে করে এই ট্রাইবুনাল নিয়ে এমন সব কথা ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে যে, সাধারণ মানুষেরা বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং প্রশ্ন তুলেছেন এই বিচারের ব্যাপারটি নিয়ে। এর আগে আমাদের শ্রদ্ধেয় রায়হান রশীদ ভাই এই ব্যাপারটি নিয়ে আলোকপাত করেছিলেন নির্মান ব্লগে লেখা তাঁর এই লেখায় । আমি মনে করছি, এই ব্যাপারে ও অন্যান্য আরো কিছু বিষয়ে আমিও কিছু যোগ করতে চাই আরেকটু বিশদ করে। সুতরাং সে কথা মনে করেই আজকের এই লেখাটি লিখতে বসলাম।
প্রশ্নঃ বর্তমানে চলা ট্রাইবুনালটি কি আন্তর্জাতিক? যদি তা আন্তর্জাতিক না হয়, কেন তা আন্তর্জাতিক নয় এবং কেন এই ট্রাইবুনালের নামের সাথে আন্তর্জাতিক শব্দটি রয়েছে? না। আমাদের ট্রাইবুনালটি আন্তর্জাতিক নয়, এই ট্রাইবুনালের বিচার প্রক্রিয়া ও ব্যাবস্থাপনা দেশীয় পদ্ধতিতে হচ্ছে। কিন্তু, এই ট্রাইবুনালে যেসব অপরাধের বিচার হচ্ছে সে অপরাধ গুলোর ব্যাপ্তি ও গন্ডি আন্তর্জাতিক। পাঠক, খুব কঠিন লাগছে আমার কথা? আসুন তবে আরেকটু সহজ করে বলি। আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালটি বলতে সকলের সামনে যে ব্যাপারটি ভেসে ওঠে, সেটি হোলো এই ট্রাইবুনালটি হবে দেশের বাইরে কোথাও, কিংবা দেশেই হবে কিন্তু এখানে আইনজীবিরা থাকবেন বিদেশী, বিচারকরা আসবেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে, এই ট্রাইবুনালে পরিচালিত যেসব নিয়ম, কানুন, আইন রয়েছে তা সবই হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মতন, ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এসব ব্যাপারগুলোকেই সাধারণ মানুষেরা আন্তর্জাতিকতার একটি প্রতিচ্ছবি হিসেবে কল্পনা করে নেন সবসময়। আসলে আমাদের এই বিচারের ক্ষেত্রে এইভাবে কল্পনা করে নেয়া বা ধরে নেয়া হলে তা হবে ভুল। এই অপরাধের বিচার করবার জন্য আমাদের একটা নিজস্ব আইন রয়েছে। এই আইনটি প্রণীত হয়েছিলো ১৯৭৩ সালে। এমন এক সময় আইনটি করা হয়েছিলো যখন পৃথিবীর অনেক দেশে তখন এই ধরনের আইনের কথা কেউ চিন্তার কাছেও স্থান দেয়নি। অথচ যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি দেশে বাংলাদেশ এই ধরনের একটি আইন করবার দক্ষতা দেখিয়েছে খুব চমৎকার ভাবেই। বাংলাদেশের বিচার ব্যাবস্থা আজকে ৪১ বছরের পুরোনো। এই সময়ের মধ্যে আমরা পাকিস্তান আমলের আইনগুলোকে সংস্কার করেছি, পরিবর্তন করেছি, ধুয়ে-মুছে সাফ করে নিয়ে আমাদের দেশের আঙ্গিকে তা আমাদের মানুষের জন্য সুন্দর করে সেট করে নিয়েছি। আমাদের দেশের অনেক মামলার রায় এখন ভারত, পাকিস্তান, মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, মালদ্বীপ, ভূটানে প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে ব্যাবহার হয়। বলা যেতে পারে যে আমরা বিচার ব্যাবস্থায় একেবারেই স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অত্যন্ত পরিপক্ক। আমাদের সুপ্রীম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিরা তাদের মেধা, জ্ঞান, প্রজ্ঞায় অনেক দূর এগিয়েছেন যার ছোঁয়া আমরা অনেক বড় বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ মামলায় হর হামেশাই দেখতে পাই। সুতরাং আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রে যখন বিচার হবে তখন আমাদের এই প্রচলিত আইনী কাঠামোতেই হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে যদি কোনো খুন হয়, ধর্ষন হয় বা যে কোনো সাংবাধানিক আইনী জটিলতা বা মামলা হয় তখন কি আমরা অন্যান্য দেশের বিচারপতি, আইনজীবির, সহায়তা নিয়ে আদালত বসাই? উত্তর হচ্ছে, না, বসাই না। কেননা আমরা নিজেরাই নিজেদের দেশে হওয়া এসব অপরাধের বিচার করতে পারি। কিন্তু সমস্যা হয়ে গিয়েছে আমাদের এই আইনটিতে একটি শব্দ নিয়ে। শব্দটি হোলো “আন্তর্জাতিক”, অনেকেই এই শব্দটির কারনে পুরো ব্যাপারটি নিয়েই বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছেন। যারা বিভ্রান্ত হয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলি- আন্তর্জাতিক শব্দটি আমাদের আইনে রয়েছে কেননা এই আইনের মাধ্যমে যে অপরাধের বিচার হবে বলে বলা হচ্ছে সেই অপরাধগুলোর ধারনা আসলে দেশ, কাল, পাত্র, স্থান ভেদে সব যায়গাতেই এক। কি সেই অপরাধগুলো? সাধারণত এই অপরাধগুলোকে যে নামে বলা হয়ে থাকে তা হচ্ছে- (১) মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (২) শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ (৩) গণহত্যা (৪) যুদ্ধাপরাধ (৫) অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধ উপরের উল্লেখিত প্রত্যেকটি অপরাধের অধীনে আবার অনেক অপরাধ রয়েছে যাদেরকে সম্মলিত ভাবে উপরের ওই বড় হেডিং এর আন্ডারে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন উদাহরন হিসেবে বলা যায়, মানবতা বিরোধী অপরাধের আন্ডারে রয়েছে- খুন করা, কাউকে দাসে পরিণত করা, দেশান্তরী করা, অবৈধভাবে আটকে রাখা ইত্যাদি। আবার যুদ্ধাপরাধের অধীনে রয়েছে- যুদ্ধকালীন সময়ের রীতিনীতি ভঙ্গ, টর্চার, ব্যাক্তিগত ও সরকারী সম্পত্তি বিনষ্ট করন ইত্যাদি। সুতরাং এই যে আমি উপরে অপরাধের কথাগুলো আপনাদের বললাম তা শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশেই একইভাবে মেনে চলে। একই আদর্শে। এই অপরাধগুলো পুরো বিশ্বের সব দেশ একই চোখে দেখে এবং একইভাবে তারা এর গুরুত্বকে বিবেচনা করে থাকে। মানে হচ্ছে, আজকে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যেই অপরাধ হয়েছে তা ধরে নেয়া হবে, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের উপরেই একটি হামলা, মানবতার উপরে হামলা, শান্তির উপরে হামলা। এবার প্রশ্ন আসতে পারে, যদি উল্লেখিত অপরাধের ধারনা সব দেশেই এক হয়ে থাকে তবে তা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে কেন নেয়া হবে না? কেন নিজেদের দেশে করা হবে? আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মূলত গঠিত হয়েছে ১৯৯৮ সালে। এই আদালতের সবচাইতে ভয়াবহ দূর্বল দিক হচ্ছে এরা ১৯৯৮ সালের আগে সংগঠিত কোনো অপরাধেরই বিচার করতে পারবে না যা তারা তাদের সংবিধিতেই বলে দিয়েছে। এই সংবিধির নাম “রোম সংবিধি”। এবং এই সংবিধির ১০ অনুচ্ছেদে বলে দেয়া হয়েছে যে, অন্য দেশ তার নিজের বিচার ব্যাবস্থায় উপরে উল্লেখিত আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করতে পারবে। এইটার সাথে তাদের আইনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আর থাকবেই বা কি করে? প্রত্যেক্টি দেশ সার্বভৌম। তাদের সবার রয়েছে নিজেদের আইন ব্যাবস্থা। সুতরাং তাদের দেশ কিভাবে বিচার করবে বা করবে না, এইটা কেউ নির্ধারন করতে পারে না। আমরা এই ব্যাপারে কয়েকটা উদাহরন দেখতে পাই পুরো বিশ্বের ইতিহাস ঘেঁটে। যেমন- (ক) মুনাএঞ্জার বিচারঃ কানাডার আদালতে মুনাইয়েঞ্জা নামক এক ব্যাক্তির বিচার হয়েছিলো। সে যুদ্ধাপরাধ করেছে ১৯৯৮ সালে রুয়ান্ডায় কিন্তু তার বিচার হয়েছে কানাডায় ২০০২ সালের দিকে। এই লোক রুয়ান্ডাতে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে ভুয়া নামে পালিয়ে ছিলো কানাডাতে। একদিন ধরা খেয়ে যায়। কানাডা সরকার রুয়ান্ডা থেকে সাক্ষী এনে বিচার করেছে নিজেদের গঠিত ট্রাইবুনালে। কিন্তু তারপরেও আন্তর্জাতিক আদালত গঠন করেনি। লক্ষ্য করে দেখেন, অপরাধ করেছে রুয়ান্ডায় আর বিচার হয়েছে কানাডায়। (খ) এডলফ আইকম্যানের বিচারঃ ঠিক তেমন এডলফ আইকম্যানের বিচার হয়েছে ইসরাইলের নিজস্ব কোর্টে। অথচ সে অপরাধ করেছে ইউরোপে এবং সেই সময় ইসরাইল নামের কোনো দেশই ছিলো না। অথচ ইসরাইল নামে দেশ হবার পর এডলফ আইকম্যানকে আর্জেন্টিনা থেকে নিয়ে এসে বিচার করা হয়েছে ইসরাইলে। অপরাধ হয়েছে জার্মানীতে অথচ বিচার হয়েছে ইসরাইলে। (গ) রেফিক সেরিকের বিচারঃ রফিক সেরিক অপরাধ করেছিলো ইয়াগোস্লোভিয়াতে। রেফিক সেরিক ছিলো একজন বসনিয়ান মুসলিম। সে নিজে বসনিয়ান মুসলিম হয়ে হাত মিলায় পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্য খুনী মিলোসোভিচের সাথে। রেফিক সেরিক রাজাকারে পরিণত হয় এবং তার নিজেদের লোকদের হত্যা করে মিলোসোভিচের সেনাদের সাথে হাত মিলিয়ে। এক সময় সে ডেনমার্কে পালিয়ে যায় এবং সেখানে সে ধরা পড়ে। তখন ডেনমার্কের আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগে ৮ বছরের কারাদন্ড প্রদান করে। লক্ষ্য করুন, তার বিচার কোনো আন্তর্জাতিক আদালতে না হয়ে হোলো ডেনমার্কের আদালতে। কেন হোলো? কারন ডেনমার্কে এই বিষয়ে বিদ্যমান আইন ছিলো। সুতরাং নিজেদের দেশের আইন ফেলে তারা আন্তর্জাতিক আদালতে কেন যাবে, যেখানে আন্তর্জাতিক আদালতের এই বিষয়ে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই? যেখানে রুয়ান্ডার অপরাধের বিচার হয় কানাডায়, জার্মানীতে করা অপরাধের বিচার হয় ইসরাইলে, ইয়াগোস্লাভিয়াতে করা বিচার হয় ডেনমার্কে, সেখানে বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধের বিচার বাংলাদেশে হতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। উপরের আলোচনাতে ব্যাপারটা স্পষ্ট। তাহলে আমরা কি দেখলাম ও বুঝলাম এতক্ষনের আলোচনাতে ? আমরা এতক্ষনের আলোচনাতে দেখলাম ও বুঝলাম যে, অপরাধের ধরনগুলো আন্তর্জাতিকভাবে, মানে সকল দেশ সম্মলিতভাবে একটা লিস্ট করে ঠিক করে নিয়েছে। কিন্তু এই বিচারগুলো তারা নিজ নিজ দেশেই তাদের আইন দিয়ে, তাদের পদ্ধতি দিয়েই করতে পারে। এইজন্য নতুন করে আদালত খুলে, অর্থ খরচ করে করার কোনো দরকার নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের নিজস্ব আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন কেউ পড়তে চাইলে এই ওয়েবসাইট টি ঘুরে আসতে পারেন। প্রশ্ন আসতে পারে, এই অপরাধগুলো কখন হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে? এর সময়কাল কি? যে কোনো সময়েই যদি এই জাতীয় অপরাধ হয় তাহলে কি ওই অপরাধের বিচার এই আইন দিয়েই হবে? এইসব প্রশ্নের উত্তর সাধারণত বলা থাকে আইনে। আর আইনে না থাকলে ওই আইন বানাবার সময়কালীন যে উদ্দেশ্য তার থেকে বুঝে নেয়া হয়। যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বুঝে নেয়া হয়েছে যে, ১৯৭১ সালে ওইসব উল্লেখিত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন ব্যাক্তিবর্গ দ্বারা আর উক্ত আইনে সেই সময়কালীন অপরাধেরই বিচার করা হবে। কিভাবে বুঝে নেয়া হয়েছে? এইভাবেই বুঝে নেয়া হয়েছে যে, তৎকালীন সময়ে এই আইন প্রণয়ন করবার সময় সংসদে সংশ্লিষ্ঠ ব্যাক্তির বক্তব্য, আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, সংবিধানে প্রণীত সংশোধনীর পেছনে উল্লেখিত কারন, এইসব। এখন যদি আপনার দেশে শেয়ার কেলেংকারী হয়, ব্যাক্তি খুন হয়, গুম হয়, দুই দল ছাত্র মারামারি করে অথবা নানান জাতীয় অপরাধ হয় তাহলেও কি এই আইনে বিচার হতে পারে? না হতে পারে না। কেননা উল্লেখিত অপরাধের জন্য বাংলাদেশে আলাদা আলাদা আইন আছে, দন্ডবিধি আছে, ফৌজদারী কোর্ট আছে। সেখানে ওইসব অপরাধের বিচার হবে। সব অপরাধের বিচার কি এক আইনে হয়? কখনোই হয় না। অপরাধের ধরন বুঝে আইন করা হয়েছে। সুতরাং বিচার চাইতে হলে সেই আইনের কাছেই যেতে হবে। আপনি চড় মারার আইন দিয়ে কি ডাকাতির মামলার বিচার করতে পারবেন? প্রশ্ন আসতে পারে যে, আপনারা তো যুদ্ধপরাধের বিচারের কথা বলেছিলেন, তাহলে সেটা করছেন না কেন? কেন করছেন মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার? উত্তরঃ এখানে যুদ্ধাপরাধের ঘটনা আনছি এই কারনেই যে, আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রে যেই অপরাধ গুলো রয়েছে তার মধ্যে যুদ্ধাপরাধ হচ্ছে একটা অপরাধের ধরন বা নাম। আমাদের আইনে যে অপরাধের কথা বলা হয়েছে সেই অপরাধের মধ্যে রয়েছে- ১) মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, ২)শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, ৩)গণহত্যা, ৪)যুদ্ধাপরাধ এবং ৫) অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধ সমূহ এখন ১৯৭১ সালে যেই ব্যাক্তি যেই অপরাধ করেছে সেই অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন (অভিযোগ গঠন) হয়েছে এবং এইভাবেই উক্ত ব্যাক্তির বিচার হবে। এমনও হতে পারে যে একজনের বিরুদ্ধে উপরের চারটি অপরাধের যোগসাজশ রয়েছে তখন ঐ সব গুলো অপরাধেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে। যেমন ধরেন কাদের মোল্লা। এই লোকের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণ হত্যা, এই দুইটি বিষয়ে অভিযোগ আনা হয়েছে। সুতরাং এই দুই বিষয়ে তার উপর মামলা চলবে। যার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হবে তার বিরুদ্ধে এই বিষয়েই মামলা চলবে। প্রশ্ন আসতে পারে যে, যদি এই বিচার আন্তর্জাতিক না হয়, তবে কেন সরকারের প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী উনারা প্রায়ই বলে থাকেন যে, “আন্তর্জাতিক মানদন্ড বজায় রাখা হবে?”, যেখানে আপনি বলছেন বিচার হবে দেশীয় পদ্ধতিতে, সেখানে আন্তর্জাতিক মান কিভাবে রাখা হবে? সুন্দর প্রশ্ন এটি। সরকারী কর্তাব্যাক্তিরা কেন ও কিভাবে বলছেন তা আমি খানিকটা গেস করতে পারি। আমি হলেও একইভাবে এবং কিছু কারন আছে বলেই বলতাম। কেন বলতাম জানেন? কারন- আন্তর্জাতিক যেই স্ট্যান্ডার্ডের কথা বলেছেন তা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে আসলে আপনা আপনিই মিলে যায়, এটা আর কষ্ট করে নিশ্চিত করতে হয়না। কেননা আমাদের আইন ও বিচার ব্যাবস্থা সেই পুরোনো বৃটিশ ব্যাবস্থারই একটি ছায়া মাত্র। এখানে গত ১০০ বছরে আইনী প্রসিজিওর গুলোই এমন যা আন্তর্জাতিক ভাবে যেই মান থাকে তারই মতন। আন্তর্জাতিক মান ধরে রাখা হয়েছে শুরু থেকেই। আন্তর্জাতিক মান বলতে বুঝায় মূলত, একজন ব্যাক্তির যখন বিচার করা হয় তখন তার মানবাধিকার, প্রসিজিওরাল স্বচ্ছতা, সুবিধা, সব কিছু নিশ্চিত করা হয় কিনা। এইসব কিছুকেই একসাথে মূলত বলে আন্তর্জাতিক মান। এর মানে হচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেভাবে বিচার ব্যাবস্থার ধাপ গুলো পরিচালিত হয়, আমরা সেগুলোই ধারন করে আসছি। এর উদাহরন হিসেবেই আমাদের ১৯৭৩ সালের আইনটি দেখা যেতে পারে। সেখানে খুব সুন্দর করে এই স্ট্যান্ডার্ডটি ধরে রাখা হয়েছে। কিভাবে? আসুন আমি নির্দিষ্ট কয়েকটা উদাহরন দেই- ১) এই আইনে অপরাধীকে দোষী প্রমাণের দায়ভার প্রসিকিউশনের যা বলা আছে ১৯৭৩ সালের আইনে ৬ নাম্বার চাপ্টার এর সাক্ষ্য অংশের ৫০ নাম্বার ধারায় । সুতরাং “the accused is presumed to be innocent until proven guilty” আইনের এই বিখ্যাত কথাটি সমুন্নত রয়েছে । সমগ্র আইনের কোথাও এই উক্তিটির বিরুদ্ধচারন করে কোনো ধারা নেই । এই কথা Article 14(2) of International Covenant on Civil and Political Rights,1966 (ICCPR) এও বলা আছে । ২) Article 14 of International Covenant on Civil and Political Rights,1966 (ICCPR)এ যে অধিকারগুলোর উল্লেখ রয়েছে তা ICTA-1973 এর ক্ষেত্রেও খুব সুন্দর ভাবে রয়েছে । আসুন দেখা যাক- ক) ICCPR এর আর্টিকেল ১৪(১) এ বলা আছে ফেয়ার এবং পাব্লিক হিয়ারিং এর কথা যা কি না যোগ্য , স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইবুনালের মাধ্যমে হতে হবে । ICTA-1973 এর ক্ষেত্রে, ধারা ৬(২ক) এর ক্ষেত্রেও যোগ্য, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন ট্রায়ালের কথা বলা হয়েছে । আবার ধারা ১০(৪) এ বলা রয়েছে , এই প্রসিডিংস হতে হবে পাবলিকলি এবং ট্রাইবুনাল যদি ঠিক মনে করে তবে ক্যামেরাও ব্যাবহার করা যেতে পারে । খ) ICCPR এর ১৪(৩) ধারায় বলা আছে যে, “Right to be informed promptly and in detail in a language which he understands of the nature and cause of the charge against him” . আবার এই কথা গুলোই বলা আছে ICTA-1973 এর ১০(১)(ক) , ১০(৩) এবং ১৬(২) ধারায় । গ) ICCPR এর আর্টিকেল ১৪(৩)(খ) ধারায় বলা আছে যে , “Right to have adequate time and facilities for the preparation of his defence and to communicate with counsel of his own choosing . একনন আমরা যদি ICTA-1973 এর দিকে নিজর দেই, তাহলে দেখব যে, এই আইনের ১৭(২) ধারায় বলা আছে , “An accused person shall have the right to conduct his own defence before the Tribunal or have the assistance of counsel” এইভাবে আমাদের আইনে মূলত অভিযুক্তের সকল অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, প্রসিজিউওরাল স্বচ্ছতা রয়েছে। আর এসব আছে বলেই আমাদের দেশের বিভিন্ন কর্তাব্যাক্তিরা সম্ভবত বলেন যে, এই ট্রাইবুনালের আন্তর্জাতিক মান ধরে রাখা হবে। প্রশ্ন আসতে পারে যে, এতই যখন এই আইন আন্তর্জাতিক মানের, তবে কেন এই আইন ও বিচার নিয়ে এত সমালোচনা? পৃথিবীতে গণহত্যার বিচারের জন্য কোনো বিচারই সমালোচনার বাইরে ছিলো না। হোক সেটি ইউনাইটেড নেশন্সের উদ্যোগে কিংবা নিজেদের দেশে গঠিত কোনো নিজস্ব ট্রাইবুনাল (যেমন বাংলাদেশ, কানাডা, ইসরাইল) নুরেমবার্গ, ম্যানিলা, টোকিও, আইকম্যান ট্রায়ালের সমালোচনার কথা তো সবাই জানেনই। ইয়াগোস্লোভিয়া ট্রায়ালে একের পর এক সমালোচনা করেছেন প্রফেসর মাইকেল পি শার্ফ,জেমস স্লোয়ান,ট্যাভেরনিয়ার, জিওফ্রে রবার্টসন কিউ সি, ডেইলি মেইলের জন লাফল্যান্ড সহ আরো অসংখ্য ব্যাক্তি। রুয়ান্ডা ট্রায়ালের সমালোচনাকারীদের মধ্যে আছেন প্রফেসর জেরেমি সারকিন, এরিন ডেইলি, ক্রিস্টোফার যে লি মন, ক্রিস্টিন এম ভেন্টার, ড.ফিল ক্লার্ক সহ অনেকেই। সিয়েরা লিওনের আদালত ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন ভ্যালেরি উস্টারভেল্ট, শ্রীরাম চন্দ্রলেখা সহ বহু স্কলার। আর কম্বোডিয়ার ট্রায়াল নিয়ে সেইগফাইড ব্লাঙ্ক, OSF সহ অগণিত সমালোচনা চলছে ইচ্ছেমত। অথচ এই বিচার গুলো ছিলো জাতিসংঘের তত্বাবধান ও তাদের সাহায্যে গঠিত বিচার। তারপরেও সমালোচনা ছিলোই। এতে করে কি সেই বিচার প্রক্রিয়াগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছে? থেমে গিয়েছে? আমাদের দেশে গঠিত ট্রাইবুনাল নিয়েও চলছে এমন ফালতু সমালোচনা ও জ্ঞানপাপীদের দৌঁড়-ঝাঁপ। আপনি যদি আজকে দাঁড়িয়ে থাকেন তবে অভিযোগ আসবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যদি বসে থাকেন, তবে অভিযোগ আসবে বসে আছেন কেন? যদি সব কিছু ঠিক থাকে, তবে অভিযোগ আসবে, “এত ভালো ভালো না কিন্তু”, মোট কথা সমালোচনাহীন কোনো কর্মই আজ পর্যন্ত সম্পাদিত হয়নি। সুতরাং এসব সমালোচকদের সমালোচনা ও অপরাধীদের ইয়ার দোস্তদের লাফালাফি চলবেই। ট্রাইবুনাল যতক্ষণ তার রাস্তামত চলতে থাকবে এবং রাষ্ট্র যতদিন আইনমাফিক ও প্রয়োজনমত তার দায়িত্ব পালন করবে ততক্ষণ কারো কিছু করবার ক্ষমতা নাই। আরো দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন প্রশ্ন আসতে পারে আইচ্ছা ভাই বুঝলাম এইটা আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল না। কিন্তু বিদেশী আইনজীবিদের আসতে না দেয়াটা কি ঠিক? বাংলাদেশে কোনো বিদেশী নাগরিক যদি প্র্যাক্টিস করতে চান কোর্টে সেখানে প্রথম রিকোয়ারমেন্ট-ই হচ্ছে যে সেই ব্যাক্তিকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। এই কথাটি বলা রয়েছে বাংলাদেশ লিগাল প্র্যাক্টিশনার্স এন্ড বার কাউন্সিল অর্ডার – ১৯৭২ এর অনুচ্ছেদ ২৭(১) এ। সেখানে ক্লিয়ারলি বলা আছে একজন ব্যাক্তি বাংলাদেশে প্র্যাক্টিস করতে হলে ক) বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে খ) তার বয়স ২১ বছর হয়েছে গ) তার শিক্ষাগত অর্জন ( এই ধারাটির অধীনে আরো কিছু ধারা আছে এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা স্পষ্ট বলা আছে) ঘ) বার কাউন্সিলের নির্ধারিত পরীক্ষায় উর্তীর্ণ হয়েছে ঙ) বিধিমালা অনুযায়ী ফিস প্রদান করা হয়েছে। লক্ষ্য করে দেখুন, এই আইনটি তৈরী হয়েছে ১৯৭২ সালে। কেউ বলতে পারবে না যে এই আইনটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে বাধা দেবার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে তৈরী হয়েছে। এই আইন্টি যেমন অপরাধীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ঠিক তেমনি প্রসিকিউশনের বেলাতেও প্রযোজ্য। এটা শুধু আমাদের দেশ না, সব দেশেই এমন নিয়ম আছে। এই ব্যাপারে আরো যদি জানতে চান, তাহলে দয়া করে পড়ুন এই লেখাটি। সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রশ্ন আসতে পারে, হ ভাই, বুচ্ছি বুচ্ছি। এই বিচার নিয়া আওয়ামীলীগ রাজনৈতিক ফায়দা নিচ্ছে। এইটা দিয়া তারা পরের বারের ইলেকশনে জিততে চায়। বিচার শেষ কবে হইবো এইটা বলেন। এই ব্যাপারে জানতে এই লেখাটি মন দিয়ে পড়ুন। তাহলে সব জানতে পারবেন।ধন্যবাদ। প্রশ্ন আসতে পারে যে, শালা তুই আওয়ামীলীগের দালাল। তুই যুদ্ধাপরাধ নিয়া কথা কস? এই বিচারের পক্ষে যারা কাজ করছেন, ক্যাম্পেইন করছেন তাদের সকলকেই প্রতিনিয়ত শুনতে হচ্ছে আমরা সবাই নাকি আওয়ামীলীগের দালাল। আমরা আওয়ামীলীগের পা চাটা কুকুর এবং আমরা আওয়ামী প্রোপাগান্ডাই নাকি বাস্তবায়িত করছি। আমি পাঠকদের কাছে শুধু কয়েকটা প্রশ্নই করতে চাই কেবল। আমার বাবা, ভাই, বোন, মা হত্যার বিচার চাওয়া এবং সেই বিচার চাইতে গিয়ে ক্যাম্পেইন করা, কাজ করে যাওয়াটা কি আওয়ামীলীগের দালালি করা? আমি কি এই স্বাধীন দেশে আমার স্বজন হত্যার বিচার চাইতে পারব না? এই বিচার যেই সরকার কিংবা যেই ট্রাইবুনাল সম্পাদন করছে তা সুষ্ঠূভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবার পক্ষে কাজ করাটা কি তবে আওয়ামীলীগের দালালি করা? আমরা তো এই দাবীও তুলেছি যে আওয়ামীলীগের ভেতরে যুদ্ধাপরাধী থেকে থাকলে তাদের বিচারও আমরা চাই। এবং সেইজন্য বার বার ডিফেন্স টিমকে আমরা অনুরোধ করে আমরা বলছি আপ্নারা ট্রাইবুনালের কাছে আবেদন করেন যাতে সেই সকল ব্যাক্তির বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া হয় খুব দ্রুত। আমাদের একটা সহজ ও সরল দাবী। সেটি হচ্ছে, ১৯৭১ সালে যারা মানবতা বিরোধী অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা কিংবা যুদ্ধাপরাধের সাথে শংস্লিষ্ঠ ছিলো সবার বিচার করতে হবে রিগার্ডলেস সেই ব্যাক্তি যে দলই করুন না কেন। আজ যদি আমার বন্ধুকে কোনো সন্ত্রাসী খুন করে ফেলে চলে যায় এবং সেটির বিচার অনুষ্ঠিত হয় সুষ্ঠু ভাবে এবং আমিও সেই বিচারের দাবীতে দৃপ্ত আওয়াজ তুলি তবে কি আমি সেই বন্ধুর পরিবারের দালাল কিংবা যেই সরকার এই বিচার করবে আমি কি সেই সরকারের দালাল? এই বিচার চাওয়াটা তো বাংলাদেশের ১৬ কোটি জনসাধারণের একটা সাধারন দাবী। এই বিচার তো শুধু কিছু দলীয় সমর্থক ছাড়া আর সকল মুক্তবুদ্ধির মানুষ প্রতিনিয়ত চান। তাদের এই চাওয়াটাই কি তবে আওয়ামীলীগের দালালি কিংবা পা চাটা? এই চাওয়ার মানেই কি হচ্ছে আমরা আওয়ামীলীগ থেকে মাসোহারা পেয়ে থাকি? প্রতিটি মানুষ একটি কথাই বলে থাকেন যে এইবার আওয়ামীলীগকে মানুষ ভোট দিয়েছে, বিশেষ করে তরুন সমাজ, কেননা তারা চায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই তরুন সমাজের প্রত্যেকেই কি আওয়ামীলীদের দালাল? একটা সহজ এবং সাধারন চাওয়া চাইতে গেলেই বুঝি স্বাধীনতার ৪১ বছর পর যেই দল বিচার শুরু করেছে সেই দলের দালাল হয়ে যেতে হয়?