ব্যাংক কেলেংকারির নেপথ্য কারিগর

রাজনৈতিক নেতারা বরাবরই যেন ব্যাংকিং খাতকে অনিয়ম ও লুটপাটের নিরাপদ জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছে। ব্যাংকিং খাতকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহার করার সংস্কৃতি থেকে তারা যেন বেরই হতে পারছে না। ব্যাংক খাতে কোন ধরনের কোন জবাবদিহিতার বালাই নেই। সংক্রামক ব্যাধির মতো এটি ছড়িয়ে পড়েছে।বাংলাদেশের ব্যাংক এবং পরিচালনা পর্ষদের তদারকি ব্যবস্থা টালমাটাল হয়ে গেছে। ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংস করার জন্য একদল লোক মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে তা কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। যারা টাকা মেরে দিচ্ছে, তাদের কিছুই হচ্ছে না। এটা বড় উদ্বেগের বিষয়।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) থেকে জানা গেছে গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতের ১০টি বড় কেলেঙ্কারিতে লোপাট হয়েছে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। এসব কেলেঙ্কারি ঘটেছে মূলত সরকারি ব্যাংকে। সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক গ্রুপ দিয়ে শুরু হলেও সবচেয়ে বেশি কেলেঙ্কারি ঘটেছে জনতা ব্যাংকে। আরও রয়েছে বেসিক ও ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা। জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপ মিলে ১১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা হাতিয়েছে। বেসিক ব্যাংক থেকে বের হয়ে গেছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক থেকে হল-মার্ক নিয়ে গেছে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। বিসমিল্লাহ গ্রুপ নিয়েছে ১ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া রিজার্ভ চুরির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হারিয়েছে ৬৭৯ কোটি টাকা। নতুন প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল ও ফারমার্স ব্যাংক থেকে লোপাট হয়েছে ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা। এবি ব্যাংক থেকে পাচার হয়েছে ১৬৫ কোটি টাকা।
ব্যাংক খাতের এই ১০টি বড় কেলেঙ্কারিতে লোপাট হওয়া ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা দিয়ে কী করা সম্ভব, তারও একটি চিত্র তুলে ধরেছে সিপিডি। সেখানে বলা হয়েছে, এই টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের ৭৮ শতাংশ বা পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের ৬৪ শতাংশ ব্যয় নির্বাহ করা যেত। আবার সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে প্রায় ৪১ শতাংশ টাকার জোগান দেওয়া সম্ভব ছিল।
ব্যাংকের ৯০ শতাংশ অর্থের জোগান দেয় আমানতকারীরা। অথচ তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার ব্যাংকে কেউ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব আমানতকারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করার। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এ দায়িত্ব পালনে অক্ষম। তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে শুধু ক্ষমতা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না, প্রয়োগ করতে জানতে হবে। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ করা কঠিন। ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে স্বাধীন কমিশন প্রয়োজন। তাছাড়া ধনী মালিকদের প্রাধান্য দিতে গিয়ে সাধারণ আমানতকারীর স্বার্থ ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
প্রভাবশালী প্রার্থীদের ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ সৃষ্টি করে পুরোনো ঋণের কিছু অংশ পরিশোধ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে খেলাপি ঋণের পুনঃ তফসিল করা হচ্ছে। পুরো বিষয়টি অত্যন্ত হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। বাজার থেকে শেয়ার কিনে যেকোনো ব্যাংকের মালিকানা নেওয়া যায়। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ কাঠামো না থাকায় এক ব্যবসায়ী গ্রুপ একচেটিয়াভাবে অনেকগুলো ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। পুরো অর্থনীতিকে কিছু ব্যবসায়ীর হাতে জিম্মি করে ফেলার একই ভুল বারবারই করা হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকিং খাতে উন্নয়নের বদলে অনুন্নয়ন হচ্ছে। অথচ এই খাতের মধ্য দিয়ে অর্থনীতি অগ্রসর হয়। এই প্রথম দেখা যাচ্ছে, আমানতকারীদের মধ্যে প্রশ্ন জাগছে—কোন ব্যাংকে টাকা রাখলে তা নিরাপদ থাকবে।রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা অনিয়ম করে ঋণ নিয়েও পার পেয়ে যান।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে ১০ জন বড় ঋণগ্রহীতার মধ্যে ৩ জন বিপদে পড়লে ২৩টি ব্যাংক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। বিপদগ্রস্ত ব্যাংকগুলোকে শর্তহীন পুনঃ অর্থায়ন করা হচ্ছে। মালিকদের পর্ষদে ছয় বছরের পরিবর্তে নয় বছর থাকার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এতে আমানতকারীরা ঝুঁকিতে পড়ছেন।
সর্বোপরি, ব্যাংক খাত ঠিক করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। এই খাতের সংস্কার আরও আগেই শুরু করা উচিত ছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ব্যাংকার ও বড় ঋণগ্রহীতা এদের প্রতি নজরদারি বাড়ানো উচিৎ।

You may also like...

Read previous post:
দুর্নীতির আরেক নাম পদ্মা সেতু!

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের একটি বিশাল অবকাঠামো প্রকল্প, যার লক্ষ্য দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে রাজধানী ঢাকার সাথে সংযুক্ত করা।  সেতুটি পদ্মা নদী পর্যন্ত...

Close