তাড়াহুড়া করে রাজাকারের তালিকা প্রকাশ নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক তুঙ্গে। ভুলভ্রান্তিতে ভরা এই রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীসহ বেশ কিছু নাম আসায় প্রকাশের দিন থেকেই বিতর্ক শুরু হয়েছে চার দিকে। স্বভাবতই ক্ষুব্ধ, সংক্ষুব্ধ তালিকায় নাম আসা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার। যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করল সেই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন, সংগঠকসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন এই তালিকা নিয়ে। তীব্র সমালোচনা হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনেও। প্রথম পর্বে মুক্তিযু্দ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১০৭৮৯ জন রাজাকারের নাম প্রকাশ করে। তালিকায় মুুক্তিযোদ্ধাদের নাম আসায় মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, অভিযোগের পরিমান বেশি হলে তালিকা প্রত্যাহার করে নেয়ার চিন্তা করা হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নাম তালিকায় আসায় ক্ষুব্ধ ট্রাইব্যুনালের অন্য প্রসিকিউটররা। সংবাদ সম্মেলন করে টিপু বলেন, তিনি ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। তালিকায় তার নাম আসায় তিনি বিস্মিত। এটি সংশোধন না হলে প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেয়ার কথাও জানান তিনি। সঠিকভাবে যাচাই বাছাই না করে কেন এই ধরনের একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের তালিকা প্রকাশ করা তা কারোই বোধগম্য নয়।
তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পরে মন্ত্রী জানান একাত্তরে প্রস্তুত করা তালিকাটিতে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংযোজন করে থাকতে পারে। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে তালিকা পেয়েছি, হুবহু তা প্রকাশ করেছি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সে সময়ের সরকারি রেকর্ড দিয়েছে, নতুন তালিকা করেনি। মোজাম্মেল হক বলেন, ১৯৭১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতকৃত রাজাকারদের তালিকা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে করা হয়েছে। নতুন করে তা সংশোধন না করে হুবহু প্রকাশ করা হয়েছে। কোন ভুল থাকলে তা অবশ্যই সংশোধন করা হবে।
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে রাজাকারের তালিকা সরবরাহের সময় প্রত্যাহার হওয়া নাম-মামলার বিষয়ে ‘নোট’ দেয়া হলেও সেগুলো বিবেচনা না করেই প্রকাশ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওই নোটগুলো বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী তালিকা প্রকাশ করার কথা।
আবার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় বলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা থেকে যেভাবে পাওয়া গেছে, সেভাবেই প্রকাশ করা হয়েছে। যেহেতু অভিযোগ পাওয়া গেছে, এ তালিকায় বেশ কিছু নাম এসেছে, যারা রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, শান্তি কমিটি বা স্বাধীনতাবিরোধী নন, বরং মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বা মুক্তিযোদ্ধা তাই এ ধরনের কোনো ব্যক্তির নাম তালিকায় কিভাবে এসেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রকাশিত তালিকায় ভুলভাবে যদি কারও নাম এসে থাকে, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই অন্তে তার/তাদের নাম এ তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে।
এখন এক মন্ত্রনালয় আরেক মন্ত্রনালয়ের উপরে দোষ চাপিয়ে পার পেতে চাইছে। আসলে এটা যারা এই তালিকা তৈরি করেছেন তাদের অদক্ষতা ও অযোগ্যতার প্রমাণ। আজকাল বেশিরভাগ কাজে দলীয় পরিচয় অন্যতম প্রধান যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা যে তালিকা করেছে তাই প্রকাশ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকার উপর নির্ভর করে করা তালিকায় বিভ্রাটতো ঘটবেই।
এর পিছনে আছে গভীর ষড়যন্ত্র। হয়ত প্রকৃত রাজাকারদের বাঁচাতে এটি ইচ্ছাকৃত ভুল। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যেমন যত্ন নিয়ে করতে হবে একইভাবে রাজাকারদের তালিকাও যত্ন নিয়ে করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে যদি কোনো মুক্তিযোদ্ধা বাদ পড়ে যান তাহলে যতটা কষ্ট হবে তার চেয়েও বেশি কষ্ট হবে কিন্তু রাজাকারের তালিকায় যদি মুক্তিযোদ্ধার নাম চলে যায়। এটা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকারে পরিণত করা অকল্পনীয় একটি বিষয়। ৪৮ বছর সময় নিয়েও সঠিক তালিকা তৈরি করা যায়নি। হয়ত ইচ্ছাকৃতভাবেই বিতর্কিত করা হয়েছে যাতে তালিকাটি বাতিল হয়, সে রকম চেষ্টা সরকারের ভেতরে অনেকেই করছে। রাজাকারের তালিকা বিতর্কিত করে একবার এটাকে প্রত্যাহার করা হলে কোনোদিন সেটা আর প্রস্তুত হবে না। এ বিষয়টি মাথায় রেখে সরকারের ভেতরে কেউ ঘাপটি মেরে আছে যারা এই কাজটি করছে। তারা জাতির সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলা করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার এই দায়টা কে নেবে?
দেশের অনেক কুখ্যাত রাজাকার যারা ক্ষমতাসীন সরকারে আছে বা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্কে জড়িত এমন কারো নাম দেখা যায়নি। আবার এমন অনেকের নাম এসেছে যারা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। এটা প্রমাণ করে ক্ষমতাসীনদের এই তালিকা করার মত সদিচ্ছা এবং সক্ষমতা আছে কি না সেটা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে।