কজন নাগরিক হিসেবে অবশ্যই মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। তবে তা পেশ করার মতলব কী, সেটা দ্বারা কী দেশের বিন্দুমাত্র উপকারে আসবে? আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর রাখার মত অবস্থা। আর যাই হোক সবাই মত প্রকাশ করলে তো আর ফলোআপ হবে হবে না। কারণ সেজন্য তো গণমান্য হওয়া লাগবে। সরকারের এম.পি. মন্ত্রী কিংবা পার্টির কোন রাঘব বোয়াল। কী কথা বলছে বড় বিষয় নয়। কে বলছে, কোন ভঙ্গিতে বলছে। সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আছে কিনা, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রস্তাব তো থাকতেই হবে। ব্যাস গুরুত্ব সহকারে লিড নিউজে ছাপা হবে। পত্রিকা খুললেই যদ্ধাপরাধীদের বিচারে দাবি অপরদিকে প্রহসনের বিচার উলে-খ পূর্বক তা বন্ধের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও মন্তব্য। সব মিলিয়ে এখন প্রধান ইস্যু সেটা জামায়াত-শিবির। কারা এই জামায়াত-শিবির। কী চায় তারা, কী কারণে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হলো সব থলের খবর বেরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আমি প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখিকে বিন্দু মাত্র বিরোধিতা করতে চাই না। বরং প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। তবে বিচারের নামে প্রহসন এবং দেশকে অস্থিতিশীল একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার বিষয়টি কোনভাবে মেনে নেওয়া যায় না। বার বার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- দেশকে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য জামায়াত নেতাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের কাঠগড়ায় উঠানো হয়েছে। তাদেরকে ফাঁসি নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশে শান্তি ফিরে আসবে। দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে সেই প্রত্যয় নিয়ে বিচারের কার্যক্রম চলছে। স্যালুট যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। তবে প্রশ্ন, শুধু জামায়াত ইসলামী কি যুদ্ধাপরাধী?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে যদি বাংলাদেশকে ক্ষুধা, দারিদ্র, বেকার, সন্ত্রাস মুক্ত করা সম্ভব হয় তবে সেটা এতো দিন পরে হলো কেন? ৪৩ বছর আগে হলে তো বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যেতে পারত। এ থেকে কী বুঝা যায় না, বিচারটা আসলে বিচারিক উদ্দেশ্যে না, নিছক একটি দল, গোষ্ঠী বা আদর্শকে ধবংস করার সিদ্ধান্ত। ইতিমধ্যে জামায়াত নেতা কাদের মোল¬াকে ফাঁসি দিয়েছে সরকার। মাওলানা একে এম ইউসুফ ও অধ্যাপক গোলাম আজমের মৃত্যু হয় জেলখানাতে। মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যুদণ্ড। কামারুজ্জামানকে ফাঁসি দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এভাবে হয়তো আরো অনেক নেতাকে ফাঁসি দেওয়া হবে। মানে সরকার তার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বলে ফাঁসি কার্যকর করবে। কিন্তু এর পরের ইতিহাস কী হবে? দৈনিক জনকণ্ঠে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরীর একটি কলাম পড়েছিলাম। সম্ভবত এ বছরের শুরুর দিকে, শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে লেখাটি প্রকাশ হয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতা নুহ আলম লেলিনকে উদ্দেশ্য করে বোধয় তিনি লিখেছিলেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক একটি স্মারক প্রকাশ করা হয়। সেখানে সম্পাদনা পরিষদে ছিলেন জনাব নুহ আলম লেলিন। চৌধুরী সাহেব একটা প্রবন্ধ জমা দেওয়া সত্ত্বে তার ঐ লেখাটি না ছেপে একটি কবিতা ছাপা হয়। জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরী আফসোস করে লেখাটিতে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তার নাম নেওয়ার মত লোক ছিল না। অথচ আমি দু’হাতে লিখে গেছি। কিন্তু আজ কেন যেন অবমূল্যায়নের চোখে দেখা হয়। তার ঐ লেখাটি আওয়ামী লীগকে এতটুকু ম্যাসেস দিতে চায় এমন সংকটপূর্ণ দিন আওয়ামী লীগের জন্য অপেক্ষা করছে। যেদিন আর কেউ শেখ হাসিনার নাম নেবে না। আওয়ামী লীগ এর নাম উচ্চারণ করবে না। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু এই শে¬াগানটি বোধহয় আর জোরে সোরে শোনা যাবে না।
ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সচিবের পদত্যাগ :
এতোদিন যুদ্ধাপরাধী আর রাজাকারের দোসরদের বিচারের দাবি দেখে আসছি। তর্ক বিতর্কের যেন শেষ নেই। একদা আমার এক বন্ধুর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বন্ধু আমার বলে ফেললেন, জামায়াত নেতারা রাজাকার না হলে কী তাদেরকে রাজাকার বলা হচ্ছে। তিনি কোনো ভাবেই তার অবস্থান থেকে দূরে আসলেন না। তিনি বুঝাতে চাইলেন মুক্তিযোদ্ধারাই তো স্বাক্ষ্য দিচ্ছেন তারা রাজাকার। জোর পূর্বক রিমান্ডের ন্যায় সবাইকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে। অবশেষে বেরিয়ে এলো রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট ও খেতাবের মূল ইতিহাস। আর প্রমাণিত হলো রহস্যময় একটি ভৌতিক গল্পের নাম ‘যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল’। স্বাস্থ্য সচিব এম. নিয়াজ উদ্দীন মিয়া ও সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসি) সচিব এ.কে এম আমির হোসেন। জালিয়াতির মাধ্যমে তারা মুক্তিযোদ্ধা সনদ কিনে নেয়। জাতির কাছে স্পষ্ট যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ বেচা কেনা হয়। নিরাপরাধী মানুষকে রাজাকার সাজানো যায়। অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানো যায়। ধিক এই সব চেতনা ব্যবসায়ী মত্তসুমী দেশ প্রেমিকদের।
জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসি স্থগিত দাবি :
বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর সহকারি সেক্রেটারী জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতা, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, লুন্ঠন সহ নানা অভিযোগে ফাঁসির রায় ঘোষণা করেছে সরকার। তবে রায় কার্যকর নিয়ে বিব্রতকর। কামারুজামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ২৭০ দিনে ১৭০ জন নারীকে ধর্ষণ, সোহাগপুরে মানুষ মেরে ট্রাকে করে শেরপুরে নিয়ে যায়। প্রিন্সিপাল আঃ হান্নানকে নির্যাতন সহ আরো কত কী…। মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আ আ স ম আরেফিন সিদ্দিকীর বন্ধু। দু’জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। ভাবতে অবাক লাগে একজন রাজাকার কী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পারে। সেখানে কী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী কেউ ছিল না? সেই সময় আজকের শাহবাগীদের পূর্বসুরীরা কেন তার ছাত্রত্ব বাতিলের দাবি তুলেনি? তাকে তো সেই সময় বিচারের মুখোমুখি করতে পারতো। কিন্তু কেন সেই সময় এ কাজটি করেনি? আমরা এখনো গ্রাম অঞ্চলে দেখি কেউ যদি সন্ত্রাসীপনায় সীমা অতিক্রম করে তখন সাধারণ লোকজন জনমত গঠন করে ঐ এলাকাকে মুক্ত করে। কামারুজ্জামান যদি এতো বড় সন্ত্রাসী হয় রাজাকার হয়, ধর্ষণকারী হয় তাহলে কেন তাকে এতাদিন বাঁচিয়ে রাখা হলো। সাধারণ মানুষ কেন তার বিরেুদ্ধে ফুঁসে উঠলো না। ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযোদ্ধা করেছিল তাদের অনেকেই তো এখনো বেঁচে আছে। আর ঐ সময় যে সব নারীরা কামারুজ্জামানের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছিল তারা কেন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে কোনো অভিযোগ তুলেনি। এমন কি ২০০৯ সালের পূর্বে কোনো থানায় তার বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত কোনো মামলা ছিল না। আর ধর্ষিতা ১৭০ জন নারী সবাই কী মারা গেছে! আজকে তারা কেন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মানব বন্ধন করে না। তারা কেন তার বিচার চাই না। সব দায় বুঝি আওয়ামী লীগের! ২০০৯ সালে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফিয়ার আয়োজিত এক প্রোগামে ড. সুলতানা কামালের সাথে একই মঞ্চে বক্তব্য দিয়েছিলেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। এছাড়া আরো অনেক প্রোগ্রামে কামারুজ্জামান সম্পৃক্ত থেকে সামাজিক উন্নয়ন মূলক কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতাদের সাথে তার অসংখ্য ফাইল ফুটেজ আছে। যখন একই সাথে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন তখন কেন কামারুজ্জামান রাজাকার হননি সে বিষয়ে আজ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষ। শেরপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান জেলা কমান্ডার ’৭১ এর রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব নূরুল ইসলাম হিরুর ছোট বোন মিসেস নূর নাহারের সাথে ১৯৭৮ সালে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের বিয়ে হয়। কামারুজ্জামান যদি রাজাকার হতো তাহলে কী একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবার তার সাথে আত্মীয়তা করতো? এ প্রশ্নগুলোর জবাব আওয়ামী লীগের কেউ কী দিতে পারবে? এদিকে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড স্থগিত রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন গুলোর কঠোর সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা- এরা কাদের মানবাধিকার রক্ষা করে? এরা অপরাধীদের মানবাধিকার রক্ষা করে। আটলান্টিকের ওপারে রাখো তোমাদের ঐ মানবাধিকার। এখানে (বাংলাদেশে) ঐ মানবাধিকার চলবে না। শেখ সেলিম আরো বলেন, তোমাদের আইন দিয়ে এখানে বিচার হয় না। আমার দেশের আইনেই আমরা বিচার করছি। কারো রক্ত চক্ষুকে বাংলাদেশ ভয় পায় না। বেশি বাড়বা না! তোমাদের মানবাধিকার আটলান্টিকের ওপারে রাখো। ইউরোপের ওপারে রাখো। আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলবা না। মহানগর নাট্যমঞ্চে যুবলীগের ৪২তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সফল করতে ১০ নভেম্বর ২০১৪ সংগঠনের ঢাকা জেলা প্রতিনিধি সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
উল্লেখ্য, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে বৈধতা নেওয়ার জন্য কেন আওয়ামী লীগ ব্যস্ত হয়ে পড়ে? যখন বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছ থেকে শুভেচ্ছা চাওয়া হয়েছিল তখন কী লজ্জা করেনি?
বাংলাদেশ একটি ভয়ানক কারাগারের নাম। যার জেলারের নাম শেখ হাসিনা (জন পিলজার)। ৭০ থেকে ৭৫ বছর নিষিদ্ধ ছিল ইখওয়ানুল মুসলিমীন, ১৫-১৬জন নেতাদের ফাঁসি দেওয়ার পরও আজও নিশ্চিহ্ন হয়নি দলটি। জামায়াতও হবে না (মাহমুদুর রহমান মান্না)। পরিশেষে এতোটুকুই বলব- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া মানেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন নয়। বরং নাগরিক জীবনের অধিকার সংরক্ষণের নামই স্বাধীনতা। এ অধিকার সংরক্ষণে আওয়ামী লীগ যদি ব্যর্থ হয়ে জনগণের উপর জুলুম নির্যাতনে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে তবে ইতিহাসে আওয়ামী লীগের স্থান কোথায় থাকবে তা সময় সাপেক্ষ মাত্র।