মেজর সিনহা হত্যাকান্ড, পুলিশ যখন ক্রিমিনাল 

 

দেশে একের পর এক হত্যা, গুমের ঘটনা ঘটেই চলছে। শুধু আওয়ামী সসন্ত্রাসী বাহিনীই নয় এখন পুলিশের মত একটি বাহিনী যাদের উপর দেশের মানুষের নিরাপত্তার ভার ন্যস্ত তারাই কিনা জড়িয়ে পরছে নানানরকম অপরাধ কর্মে।গত ৩ জুলাই ‘জাস্ট গো’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ট্রাভেলস শো ডকুমেন্টারির শুটিংয়ের জন্য তিনজন সহযোগীসহ কক্সবাজারের নীলিমা রিসোর্টে ওঠেন মেজর অবসরপ্রাপ্ত সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এই খবর পৌঁছায় টেকনাফের তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমারের কাছে। তখন থেকেই ওসি প্রদীপ অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘ভিডিও পার্টিকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে যেকোনো মূল্যে।’ এরপর থেকেই সিনহাকে নজরদারিতে রাখেন পরিদর্শক লিয়াকত ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত।

মূলত ওসি প্রদীপের অপরাধ সাম্রাজ্যের কথা জেনে ফেলেন মেজর সিনহা। ওসি প্রদীপের ইয়াবা বাণিজ্য নিয়ে ইন্টারভিউ নিতে চাইলে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়।

৩১ জুলাই রাত ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের দিকে আসার পথে বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন পুলিশের চেকপোস্টে তল্লাশির নামে গাড়ি থেকে নামিয়ে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদকে গুলি করে হত্যা করে ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী। আর হত্যার মূল পরিকল্পনা করেন ওসি প্রদীপ। পরে লিয়াকতসহ বাকি আসামিদের নিয়ে মাদক উদ্ধারের নাটক সাজানো হয়। ওই সময় সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলামকে (সিফাত) পুলিশ গ্রেফতার করে। এরপর সিনহা যেখানে ছিলেন, সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তার ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকে আটক করে পুলিশ। পরে নুরকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এই দুজন যদিও পরে জামিনে মুক্তি পান।

সিনহা হত্যার ঘটনায় টেকনাফ ও রামু থানায় পৃথকভাবে মোট চারটি মামলা হয়। ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করে। চারটি মামলারই তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাব। একপর্যায়ে র‌্যাব এ ঘটনায় প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলীসহ ১৪ জনকে গ্রেফতার করে। তাদের ১১ জন পুলিশ সদস্য ও ৩ জন গ্রামবাসী। আর পাল্টাপাল্টি পুলিশের করা তিনটি মামলার তদন্তে উত্থাপিত অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি র‌্যাব।

এই হত্যাকান্ডের মূল কারিগর টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাস। যে কিনা অস্ত্র ও নির্যাতনের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। সরকারি অস্ত্র ব‌্যবহার করেও বহু অনৈতিক কাজ করেছে সে। এমনকি এই আলোচিত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য এবং অন্যখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টাও সে করেছে। আর তার এই প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করে অপর আসামি এসআই লিয়াকত আলী, মো. নুরুল আমিন, পুলিশের সোর্স মুহাম্মদ আয়াজ ও মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন।  আবার লিয়াকত আলীকে সহযোগিতা করেন আরেক পুলিশ সদস্য নন্দ দুলাল। পাশাপাশি এপিবিএনর তিন সদস্যদের সহায়তায় এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।

এসআই হিসাবে পুলিশে যোগ দেওয়ার পর ঘুরে ফিরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ২৫ বছর কাটিয়ে দেওয়া এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ ভয়ঙ্কর সব অভিযোগের শেষ নেই। এরপরও সে ছিলো বহল তবিয়তেই। চট্টগ্রামের চন্দনাইশের কাঞ্চন নগর থেকে দুই ভাইকে ধরে নিয়ে যায় থানায় এরপর ফোনে আট লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে তাদের ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার হুমকি দেয়া হয়। পরদিন যোগাযোগ করা হলে মর্গ থেকে তাদের লাশ নিয়ে যেতে বলেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ।

তবে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পেত না। সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খান খুনের ঘটনায় কারাবন্দি হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তার গুলিতে স্বজনহারা, জীবনের তরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন অনেকেই।

অনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে প্রদীপ আয় করেছেন শত শত কোটি টাকা। দেশ-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। চট্টগ্রাম নগরীতেই তার নামে বেনামে বেশ কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। ডিবি ছাড়াও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের তিন থানার ওসি ছিলেন প্রদীপ কুমার দাশ। তবে সবকটি থানা থেকে তাকে প্রত্যাহার করতে হয়েছে নানা অপকর্মের কারণে। নগর পুলিশে দায়িত্বপালন কালে অসৎ কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ মদদ পেতেন প্রদীপ। বিনিময়ে তারা পেতেন অবৈধ আয়ের ভাগ। এতে দিনে দিনে আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেন এই কর্মকর্তা। বরখাস্ত অবস্থায়ও তাকে গানম্যান নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরতে দেখা যেত।

তার বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের প্রকাশ্যে গুলি করার অভিযোগ আছে। বিভিন্ন সময়ে তাকে সাময়িক ভাবে বরখাস্তও করা হয়েছে। পতেঙ্গা থানার ওসির দায়িত্ব পালনকালে আদালতের অনুমতি ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে আসা বিদেশি জাহাজকে তেল সরবরাহে বাধা দেওয়া, বার্জ আটক এবং বার্জ মালিকসহ ১২ ব্যক্তিকে মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। পুলিশ সদর দফতর গঠিত তদন্ত কমিটি প্রদীপকে অভিযুক্ত করলে পতেঙ্গা থানা থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। তার বিরুদ্ধে মানুষকে থানায় ধরে এনে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে অনেক।

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়, লোকাল রাজনীতি হোক বা জাতীয় রাজনীতি সবখানেই পুলিশ সরকারের হাতের পুতুল হয়ে কাজ করে। আর তাতেই তাদের মধ্যে একটা ভাব তৈরি হয়েছে। মূল বিষয়টি হচ্ছে গণতন্ত্রের সংকট। একটি দেশে গণতন্ত্র যত দুর্বল হয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ততটা দুর্বল হতে থাকে। আর এরই ফলে পুলিশ প্রশাসনের মতো জায়গায় ক্ষমতার দাপটে ঘুরে বেড়ায় ওসি প্রদীপের মতো ক্রিমিনালরা।

You may also like...

Read previous post:
মুসলিমরা দাবি করে কোরানে কোনো বৈজ্ঞানিক ভুল নেই

মুসলিমরা দাবি করে কোরানে কোনো বৈজ্ঞানিক ভুল নেই। একটা মাত্র বৈজ্ঞানিক ভুল বের করতে পারলে নাকি তারা বুঝে যাবে ইসলাম...

Close