বাংলাদেশ সরকার ও প্রশাসনের দুর্বলতা ও দুর্নীতির কারণে বিভিন্ন ব্যক্তিরা নানা কৌশলে অর্থ লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে। সে অর্থ শুধু কানাডায় নয়, অন্য দেশেও যায়, সে তথ্য সরকারি নথি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণাতেও আছে।
বাংলাদেশ থেকে প্রধানত ১০টি দেশে এ অর্থ যায়। ১. যুক্তরাষ্ট্র ২. যুক্তরাজ্য ৩. কানাডা ৪. অস্ট্রেলিয়া ৫. সিঙ্গাপুর ৬. হংকং ৭. সংযুক্ত আরব আমিরাত ৮. মালয়েশিয়া ৯. কেইম্যান আইল্যান্ডস ও ১০. ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস।
অর্থসম্পদ লুটপাট ও বিদেশে পাচার এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। প্রশ্ন হচ্ছে কে বা কারা কোথায়, কোন দেশে, কি পরিমাণ অর্থ পাচার করছে সে হিসেব নিয়ে। এ নিয়ে বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট সমন্বিত কোনো তদন্ত, গবেষণা নেই। অর্থ পাচারের প্রসঙ্গ এলেই সবার আগে নজর পড়ে কানাডার দিকে। কানাডা অবশ্যই লুটেরাদের অর্থ পাচারের একটি আলোচিত গন্তব্য। কিন্তু, বিষয়টা এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যেন কানাডাই একমাত্র লুটেরাদের আস্তানা। সেখানেই একমাত্র অর্থ পাচার করা হচ্ছে।
সম্প্রতি, কানাডার ফেডারেল সংস্থা ফিনট্র্যাক (The Financial Transactions and Reports Analysis Centre of Canada (FINTRAC) গত এক বছরে অর্থ পাচারের ১ হাজার ৫৮২টি সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত তথ্য কানাডার সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস ও আরসিএমপির কাছে হস্তান্তর করেছে। এই বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, রাজনীতিবিদেরা না, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকুরেরা। কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশিদের বিষয়ে গোপনে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। উনি যেখানে এই ধরনের মন্তব্য করলেন সুনির্দিষ্ট তথ্য যদি সরকারী চাকুরীজীবিদের বিরুদ্ধে থেকেই থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হল না কেন? এই জবাব কে দেবে?
পাচার কারা বেশী করেন? ব্যবসায়ী, রাজনীতিবীদ নাকি সরকারী চাকুরে— তা তদন্ত করলেই বেড়িয়ে আসবে। কিন্তু, এটাতো স্পষ্ট যে, সরকারের সহযোগিতা ছাড়া কারো পক্ষেই এ কাজ করা সম্ভব না।
ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুরে ২২৭ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। দেশের গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
এ বছর ২১ আগস্ট দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহামুদ শামীমকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) গ্রেপ্তার করেছে। একই জেলার দুই হাজার কোটি টাকা অবৈধ উপায়ে অর্জন ও পাচারের অপরাধে গত ২৬ জুন শহর আওয়ামী লীগের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেলের বিরুদ্ধে ঢাকার কাফরুল থানায় সিআইডি মামলা করেছে।
অর্থপাচারের মাধ্যমে বাংলাদেশিরা যেসব দেশে বাড়ি করেছেন, সেসব দেশের মধ্যে মালয়েশিয়া অন্যতম। মালয়েশিয়া সরকারের ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের আমলা, রাজনীতিবিদসহ কয়েক হাজার নাগরিক নাম লিখিয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে অনেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছেন স্থানীয় কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে। সেখানে কয়েক হাজার বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। এছাড়াও গার্মেন্টস কারখানা, ওষুধ শিল্পসহ নানা খাতে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। অনেকে রাজধানী কুয়ালালামপুরসহ বড় বড় শপিং মলে দোকানও কিনেছেন। এসব সংবাদ মাঝে মধ্যেই দেশের গণমাধ্যমে আলোচিত হয় তারপর কোন এক নতুন ইস্যু তৈরী করে সেই আলোচনা অন্যদিকে ডাইভার্ট করে দেওয়া হয়। এতো এই সরকারের পুরনো কৌশল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে বিদেশে অর্থ নেওয়ার সুযোগ নেই। অবশ্য একজন রপ্তানিকারক ব্যবসা বাড়াতে অন্য দেশে লিয়াজোঁ অফিস খোলা ও ব্যয় নির্বাহের জন্য বছরে ৩০ হাজার ডলার পর্যন্ত নিতে পারেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। তবে এর বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠানই বিদেশে বিনিয়োগ করেছে। অনুমোদন ছাড়া কেউ দেশের বাইরে টাকা নিলে অর্থ পাচারের অপরাধ। তারপরেও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন স্থানে অর্থ পাচার হয়ে চলে যায়।
২০০৪ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ছিল ৩৬৫ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের হিসেবে অনুযায়ী এখন সেখানে আছে ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ বেড়েছে এক হাজার ৩৭০ গুণ! লুটেরাদের দ্বিতীয় আবাসভূমি ‘বেগমপাড়া’ শুধু কানাডাতেই নয় অন্যান্য দেশেও আছে।
বিভিন্ন দেশের অবৈধ অর্থের লেনদেন ও পাচার নিয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) কাজ করছে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। ২০০৮ থেকে এ অর্থ পাচার হচ্ছে এবং তা ক্রমেই বাড়ছে। এর মানে সরকারের নাকের ডগা দিয়েই এই পাচারকার্য চলছে আর এতে সরকারেরও যোগসাজশ রয়েছে।