আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের প্রথম এবং প্রাচীনতম দল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডলের পরিবর্তনের চাক্ষুষ সাক্ষ্য হচ্ছে আওয়ামীলীগ। মুক্তিযুদ্ধের আগের সামাজিক পরিবর্তন আগের লেখায় আলোচনা করেছি, আর সে প্রেক্ষিতে আওয়ামীলীগের রূপ পরিবর্তনও সে লেখায় ফুটে উঠেছে।
তবে ৭১ থেকে ৭৫ সময়কালটা ভিন্ন। এই সময় ঘটনাবহুল, ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত, রক্তাক্ত আর হিংস্র। সদ্য স্বাধীন দেশের সমস্যা, চ্যালেঞ্জ, বিভাজন, অভাব, আকাঙখা, হতাশা, প্রাপ্তি ছিল ভিন্ন জনপদে ভিন্ন। যেটা স্বাভাবিক। শত শত বছর পরে স্বায়ত্তশাসন পাওয়া বাংলাদেশী বাঙালিরা যেমনটা আশা করেছিলেন, যে জাত্যাভিমানের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন তার বাস্তবায়নে তারা নিজেদের আবিষ্কার করেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আওয়ামীলীগের দুঃশাসনের গ্যাড়াকলে ফাঁসা অবস্থায়! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না!
স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচনে আওয়ামীলীগের ভোট চুরি তাদের স্তম্ভিত করেছিল। শেখ মুজিবের গ্রহণযোগ্যতা এতই বেশি ছিল যে মানুষ তার কথায় মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। সে লোকের কী কোনো প্রয়োজন ছিল ভোট চুরি করার? কিন্তু তারা করেছে!
স্বাধীন দেশে নব্য ধণিক শ্রেণি নিজেদের ক্ষমতার কেন্দ্রে দেখতে সকল উপায় অবলম্বন করেছিল। এদের কোন আদর্শ ছিল না, কোন সামাজিক পরিবর্তনের আকাঙ্খা ছিল না। ক্ষমতা ছিল এদের মূল লক্ষ্য। আর তারা ক্ষমতার সিড়ি হিসাবে পেয়েছিল আওয়ামীলীগকে। আওয়ামীলীগের লোভে তারা সুযোগ পেয়েছিল হাজার বছর ধরে নিপীড়িত বাঙালিদের উপর শোষণের। মুক্তিযুদ্ধ করে যেন শুধু শোষকের ভাষা বদলেছে, শোষণের ধরণ বদলে নি।
আব্দুল গাফফার চৌধুরী, এম আর আখতার মুকুলরা যখন ইতিহাস লেখেন তারা লেখেন মুজিবকে বাঁচিয়ে। তাদের লেখায় মুজিব চরম জনপ্রিয় নেতা যার চোখ এড়ানো অসম্ভব। তারা মুজিবকে একটা over arching father figure হিসাবে দেখান, যেন মুজিব তার বাহুডোরে সারাটা জাতিকে আশ্রয় দিয়েছেন, মুজিবের দয়া সাত সাগরের সমান!
অথচ একই সময়ে তারা একটা দূর্নীতি পরায়ন রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামীলীগকে দেখান। যেন মুজিব ছাড়া আওয়ামীলীগের সবাই দোষী, শুধু মুজিবকে লুকিয়েই সবাই দূর্নীতি করেছেন। একই সাথে মুজিব কীভাবে সবার খেয়াল রাখেন, কিন্তু দূর্নীতির ব্যাপারে বেখেয়াল হতে পারেন?
মুজিব তার জীবনের শেষ অংশে সমাজতন্ত্র এনেছেন বাংলাদেশে! তিনি জীবনের কোনো অংশেই সমাজতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন না, সমাজতন্ত্রের সমর্থকও না। তিনি হঠাৎ করেই সমাজতান্ত্রিক হয়ে পড়লেন কেন? এর মূল কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে যারা আছে তাদের সাথে সম্পর্কের উন্নতি করা। কিউবা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চিলি, ভেনিজুয়েলা ইত্যাদি দেশের সমাজতান্ত্রিক সরকারের সাথে মিলে তিনি বিশ্বের বিপ্লবী নেতা হতে চেয়েছিলেন। নিজের দেশের ব্যাপারে তার কোনো খেয়াল ছিল না।
অন্যান্য দেশের সমাজতান্ত্রিকতা জনগণ ধারণ করেছে কারণ তাদের সরকার প্রধানরা সমাজতন্ত্র ধারণ করেছে। বাংলাদেশে মুজিবের পলিটিকাল স্টান্ট কাজে দেয় নি কারণ তিনি সমাজতান্ত্রিক নেতা কখনোই ছিলেন না। পুজিবাদি আমলাতন্ত্র বহাল রেখে তিনি দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও পারতেন না।
দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও, কৃষক-শ্রমিকের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পরও দেশে কৃষকের জন্য পাম্প কেনা হয় নি, কেনা হয়েছে বেবি-ফুড! সেচের মেশিন না কিনে বাংলাদেশ টেলিভিশনে টাকা ঢালা হয়েছে। এসব সমাজতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না।
মুজিবের যে সর্বগ্রাসী চিত্র আঁকেন ইতিহাসবিদরা সেটার সাথে এই তথ্যের কোনো মিল নেই! দুইটা ব্যাপার একই সাথে সত্য হতে পারে না, সত্য হওয়া সম্ভব না। স্বাধীনতাত্তোর মুজিব জননেতা ছিলেন না, জনবিচ্ছিন্ন ছিলেন। এ কথা দিবালোকের মত সত্য। যদি তাই না হবে তবে তাজউদ্দীন আহমদের পতনের কোনো সঠিক কারণ আর কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব হবে না।
মুজিব দালালদের দিয়ে নিজেকে ঘিরে রেখেছিলেন, কারণ তিনি তোষামোদ পছন্দ করতেন। তাকে যে বড় নেতা বলা হয় তিনি তা নন!