বাংলাদেশের পাট বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। এছাড়া, এ দেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জীন আবিষ্কার করেছেন। পাট থেকে পলিব্যাগও আবিষ্কার করেছেন। সম্ভাবনাময় আন্তর্জাতিক বাজারের ১০ শতাংশ দখল করতে পারলে শুধু এই পাট দিয়েই আমাদের বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলেও পাট খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কিন্ত আমাদের পাটপণ্য নিয়ে তেমন কোনো প্রচার নেই। সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে ভারত। অন্যদিকে, দক্ষ জনশক্তির অভাব, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা এবং বিপণনে দক্ষতা না থাকার কারণে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে।
ভারত বাংলাদেশ থেকে পাটের কাঁচামাল কিনে সেটা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিদেশে বিক্রি করছে এবং মুনাফা গড়ছে। এই অবস্থায়ও পাটের প্রধান ও সর্বোৎকৃষ্ট মানের উৎপাদনকারী দেশ-বাংলাদেশের পাটকলগুলো লোকসান দিচ্ছে, যা অযৌক্তিক-অগ্রহণযোগ্য।
পূর্ব বাংলার পাটের সুখ্যাতি ছিল বিশ্বব্যাপী। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকলের স্থান নেয় আদমজী জুট মিলস। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পাটকল স্থাপনের সুবাদে রফতানি আয়ের প্রধান খাত হয়ে দাঁড়ায় পাট। স্বাধীনতার পরপরই এ দেশের পাট মহা ষড়যন্ত্রের কবলে নিপতিত হয়। এরই অংশ হিসাবে মাঝে মধ্যে পাট কলে আগুন, পাট গুদামে আগুন, পাট বহনকারী নৌকা ও বার্জ ডুবে যাওয়া ইত্যাদি ঘটতে থাকে।
এভাবে ধারাবাহিক লোকসানের কারণে ৩৫টি মিল সাবেক মালিকের কাছে ফেরত দেওয়া হয় এবং কিছু মিল ব্যক্তিমালাকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়।এভাবে দেশের সরকারি পাটকল বন্ধ হতে হতে সর্বশেষ ২৬টিতে এসে ঠেকেছিল। তার মধ্যে মনোয়ার জুট মিল ছাড়া ২৫টি ছিল উৎপাদনে। তাও চূড়ান্তভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে গত ১ জুলাই। এই মিলগুলোর মধ্যে ঢাকায় ৭টি, চট্টগ্রামে ১০টি ও খুলনায় ৮টি অবস্থিত। ফলে দেশের পাটকলে সরকারের অংশগ্রহণের অবসান ঘটেছে।
খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত নয়টি জুটমিল বন্ধ থাকায় কয়েকদিনেই চার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশন (বিজেএমসি) সূত্র জানায়, প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শঙ্কায় সরকারি নির্দেশে গত শনিবার থেকে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত নয়টি জুট মিল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মিলগুলো হলো- ক্রিসেন্ট জুটমিল, প্লাটিনাম জুবিলি জুটমিল, খালিশপুর জুটমিল, দৌলতপুর জুটমিল, স্টার জুটমিল, ইস্টার্ন জুটমিল, আলিম জুটমিল, জেজেআই ও কার্পেটিং জুটমিল।
এছাড়াও বন্ধ হয়ে গেছে ৭৮ বছরের পুরনো পাটকল নরসিংদীর ইউএমসি জুটমিল। সেই সাথে চাকরির সংস্থান হারিয়েছেন মিলের পাঁচ সহস্রাধিক শ্রমিক-কর্মচারী। ইউএমসি জুট মিলের সাথে বন্ধ করা হয়েছে পলাশের বাংলাদেশ জুট মিল নামে আরেকটি পাটকল। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী তাদের বকেয়া বেতন ছাড়া কিছুই পাবেন না। এই অবস্থায় মারাত্মক দুর্ভোগে পড়বে শ্রমিক-কর্মচারীর পরিবারগুলো। কমহীন হয়ে পড়েন প্রায় ৪০০০ জন শ্রমিক। দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক মন্দা চলায় মিল বন্ধ করে দিতে তারা বাধ্য হচ্ছে। ২৯ জানুয়ারি থেকেই কারখানা বন্ধ ছিল।
সর্বোপরি দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণেই মিলগুলোর লোকসান হয়েছে। সেগুলো দূর না করে ২৫টি জুট মিল বন্ধ করে প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিক এবং আরও প্রায় অনুরূপ সংখ্যক অস্থায়ী শ্রমিককে বেকার করা হয়। তাই সরকারি ২৫টি মিল বন্ধ করে দেওয়া কেউই মেনে নিতে পারছে না। করোনা মহামারীসৃষ্ট বৈশ্বিক এই মহামন্দায় সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের অসংখ্য মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণির মানুষ কাজ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে, অনাহারে-অর্ধাহারের দিন কাটছে তাদের। এছাড়া, এই ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে আরও নানাবিধ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জনমনে। সারাদেশে পাটকলের সঙ্গে প্রায় তিন কোটি মানুষের রুটি-রুজি জড়িত।
যেহেতু বিশ্বব্যাপী পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা রয়েছে প্রচুর তাই এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা উচিৎ। এ জন্য প্রয়োজন খুব দ্রুত দেশের পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তিনির্ভর হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া বৈশ্বিক চাহিদা মাফিক পাটপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করতে পারলে, পাটকলগুলোকে স্বল্প সুদে প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণ প্রদান করা, দক্ষ লোক নিয়োগ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অব্যবস্থাপনা বন্ধ করতে পারলে পাটের কদর আরো বৃদ্ধি পাবে, ঐতিহ্য ফিরে আসবে, কৃষকরা লাভবান হবে, দেশের পরিবেশের উন্নতি হবে, রফতানি অনেক বাড়বে। দেশের সার্বিক কল্যাণ হবে।