গেলো বছরে ছেলে ধরা গুজবে বেশ কয়েকটি গণপিটুনির ঘটনায় মৃত্যু ঘটে। তার মধ্যে গত বছরের ২০ জুলাই সন্তানের ভর্তির খোঁজ নিতে গিয়ে রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনিতে নিহত হন তাসলিমা বেগম রেণু।তাসলিমা মূলত ওই স্কুলে তার দুই সন্তানের ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন। পরে তাকে পিটিয়ে মারার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
তাসলিমাকে মারার দৃশ্য ভিড় করে মানুষ দেখছিলেন এবং অনেকে ভিডিও করছিলেন সেই দৃশ্য। কিন্ত কেউই তাকে বাঁচাতে আসেনি।পরে নিহতের বোনের ছেলে নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। সেই মামলায় অজ্ঞাত ৪ থেকে ৫শ জনকে আসামি করা হয়।
রেনুরা একভাই ও পাঁচবোন। তিনি ছিলেন সবার ছোট। পড়ালেখা শেষ করে ঢাকায় আড়ং ও ব্র্যাকে চাকরি করেছেন। টিউশনিও করাতেন। পারিবারিক কলহের কারণে বছর দুয়েক আগে স্বামীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে। বিচ্ছেদের পর ছেলে তাসফিক আল মাহী (১১) বাবার সঙ্গেই থাকছে। আর মেয়ে তাসলিমা তুবাকে (৪) নিয়ে তিনি থাকতেন মহাখালীতে।
স্বজনেরা জানান, আগামী বছরের জানুয়ারিতে বড়ভাই আলী আজগরের কাছে আমেরিকায় যাওয়ার কথা ছিল রেনুর। কিন্তু একেবারে পরপারেই চলে গেলেন তিনি। নির্মম মৃত্যু তাকে কেড়ে নিল না ফেরার দেশে। মা কে হারিয়ে নিহত তাসলিমা বেগম রেনুর (৪০) শিশু কন্যা তুবার (৪) কান্না যেন কিছুতেই থামছিল না। অবুঝ শিশুটিকে সান্ত্বনা দেবার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছিল না কেউ। তার কান্নায় শোক ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের মানুষজনের মাঝেও। কেউ জিজ্ঞাসা করলেই সে বলছিল, ‘মা ড্রেস আনতে নিচে গেছে’।
মেয়েকে ভর্তির জন্য ওই স্কুলে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গুজব ছড়িয়ে এই নিরীহ নারীকে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানায় তার পরিবারের সদস্যরা।
গণপিটুনির ভিডিওতে দেখা যায়, বাড্ডার অল্প কয়েকজন যুবকই মারছে তাকে। বাকিরা দেখছে, কেউ কেউ কাছ থেকে মোবাইলে ভিডিও করছে। ৮-১০ মিনিট লাঠিপেটার পর আবার উপর্যুপরি লাথি দেয়া হয়। আধা ঘণ্টারও বেশি সময় গণপিটুনির পর তাসলিমা বেগম রেনুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে তিনি মারা যান।
এ অবস্থায় তাসলিমা বেগম রেনুর পরিবারে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করেছিলেন আড়ং, ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানে, পড়িয়েছিলেন স্কুলেও। বিবাহ বিচ্ছেদের পর ঘরেই কাটাচ্ছিলেন অধিকাংশ সময়। উচ্চ শিক্ষিতা সংগ্রামী একজন নারীর ভাগ্যে এমন পরিণতি মেনে নিতে পারছে না কেউ।
এই হত্যাকাণ্ডের জন্য গোটা সমাজকেই দায়ী করছে তাসলিমার পরিবার। সবকিছু ছাপিয়ে তাসলিমা বেগম রানুর আদরের দুই সন্তান তাহসিন আল মাহিদ ও তাসনিম তুবার ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তিত সবাই।
রেনুর ছোট্ট অবুঝ মেয়ে তুবা জানে না তার মায়ের এই নির্মম পরিণতি। মা যাবার আগে তাকে বলেছিল নতুন জামা নিয়ে আসবে। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে নতুন জামা আর পাওয়া হলো না ছোট্ট তুবার।
স্বজনরা চান, আর কারও যেন এমন করুণ পরিণতি না হয়। পাশাপাশি এই হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবি জানান তারা। আর সুশীল সমাজ বলছেন, গুজব প্রতিহত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। পাশাপাশি সনাক্ত করতে হবে গুজব সৃষ্টিকারীদেরও। গুজবের কারণে আর কারো যেন তাসলিমা আক্তার রেনুর মতো করুণ নির্মমতার শিকার হতে না হয়। তুবার মত কোন শিশুকে যেন হারাতে না হয় তার মাকে।