জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ৯০ বছর বয়সী এরশাদ রক্তে সংক্রমণসহ লিভার জটিলতায় ভুগছিলেন। গত বছরের ২২ জুন সিএমএইচে ভর্তি করা হয় তাকে।
জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এবং দুর্নীতির দায়ে জেল খেটেও জেনারেল এরশাদ প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতা এবং ভোটের রাজনীতিতে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, উভয়েই নানা সময় তাকে নিয়ে টানাটানি করেছে। নানান আলোচনা-সমালোচনা-বিতর্কের মধ্যেও তিনি টিকে ছিলেন রাজনীতিতে। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে সেই অধ্যায়ের অবসান ঘটল।
তার জন্ম ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। তিনি রংপুর জেলার দিনহাটায় জন্মগ্রহণ করেন। এরশাদ বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান, এককালীন প্রধান সামরিক প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা।
জেনারেল এরশাদ সামরিক বাহিনীতে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ষাটের দশকে। মেজর থেকে পদোন্নতি পেয়ে এক সময় স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধান সামরিক প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালেই প্রতিষ্ঠা করেন রাজনৈতিক দল।
রাজনৈতিক ক্রান্তিকালের সুযোগ নিয়ে নিজেই সামরিক শাসন জারি করেছিলেন। স্বৈরপন্থায় ক্ষমতায় এসে স্বৈরশাসক বনে যান এরশাদ। ভালবাসার বন্ধুরা তাকে পল্লীবন্ধু জানে। আবার কারও কাছে স্বৈরাচার। এ দুটি পরিচয়ের বাইরেও এরশাদের বহুমুখী পরিচয় মিলেছে।
দীর্ঘ নয় বছরের শাসনামলে এরশাদের উল্লেখযোগ্য ভাল উদ্যোগের একটি হলো তিনি দেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু করেন এবং ১৯৮৫ সালে প্রথম উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ভোটের রাজনীতিতে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবে ছিলেন জেনারেল এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টি। তার নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে সরাসরি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকেই অংশ নিয়েছিল।
এর পর ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনেও – জেনারেল এরশাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও – জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের সাথে থাকতে হয়েছিল। সর্বশেষ একাদশ সংসদেও আওয়ামী লীগের সাথে থেকে জাতীয় পার্টি ২২টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসে।
জেনারেল এরশাদ ১৯৯৮ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যোগ দিয়েও অল্প কিছুকাল পরেই আবার বেরিয়ে এসেছিলেন।
ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরে দাড়ান জেনারেল এরশাদ।দিনটিকে আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’, বিএনপি ‘গণতন্ত্র দিবস’ এবং এরশাদের জাতীয় পার্টি ‘সংবিধান সংরক্ষণ দিবস’ হিসেবে পালন করে। কোন কোন রাজনৈতিক দল দিনটিকে ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ হিসেবেও পালন করে থাকে।
ওই সময় আন্দোলনকারী দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে তিন মাস মেয়াদের একটি অন্তরবর্তীকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি।
এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে জয়লাভ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। তারা পায় ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট। আসন পায় ১৪০টি। বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পায় ৩০ দশমিক ১ শতাংশ ভোট, ৮৮টি আসন। গণআন্দোলনের মুখে পতনের পরও এরশাদের গঠিত জাতীয় পার্টি চতুর্থ রাজনৈতিক দল হিসেবে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পায়, আসন পায় ৩৫টি।
১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। ছয় বছর অবরুদ্ধ থাকার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্তি পান।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে তিনদিনের শোক ঘোষণা করে তার দল। নানা বিতর্কের পর বনানীর সামরিক কবরস্থানেই দাফন করা হয় সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের মরদেহ। এইচ এম এরশাদ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশের রাজনীতিতে ছিলেন সক্রিয়। জাতীয় পার্টির ভোটব্যাংক গড়ে উঠেছিল এরশাদকে কেন্দ্র করেই। তার মৃত্যুর পর তার গড়ে তোলা দলে ভাঙনের সুর বেজে ওঠে। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় জাতীয় পার্টি।