অভিবাসী জীবনে ভিনদেশী সংস্কৃতি গ্রহণে উদার হোন।

শান্তির দেশ হিসেবে পরিচিত নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জঙ্গি হামলার বিষয়ে কিছু কথা বলা খুব দরকার। দুটি মসজিদে নামাজরত মুসলমানদের ওপর শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদে বিশ্বাসী ব্রেনটন টারান্ট নামের এক সন্ত্রাসীর নৃশংস আক্রমণে ৫০ জন মুসল্লির মৃত্যু সারা বিশ্বকে আবার প্রচণ্ড একটা ধাক্কা দিয়ে গেল। এমন বর্বরোচিত হামলায় পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ বিস্ময়ে হতবাক। কিন্তু আমি একটু অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করতে চাই। আমার কথা শুনলে আপনার হয়তো মনে হবে আমি এই হামলার জন্য দায়ী করছি ভুক্তভোগীদের। কিন্তু না, একটা আদর্শ দিয়ে অনুপ্রাণিত একজন জঙ্গি এই হামলার জন্য দায়ী। আর দায়ী সে আদর্শ। ব্যাপারটা পরিষ্কার করে নেওয়া ভাল। হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাঁরা নির্দোষ। দোষী খুনী আর আর আদর্শিক মতবাদ৷

সমাজতত্বে তথা সোশিওলিঙ্গুইস্টিকসে (সামাজিক-ভাষাবিদ্যা?) একটা ব্যাপার আছে। যেটা কাজ করে একজন বা একদল লোকের অন্য একটা ঐতিহ্য-সংস্কৃতির দেশের লোকের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার (বা না নেয়ার) সাথে দ্বিতীয় ভাষা শেখার সম্পর্ক নিয়ে৷ (অভিবাসীর নিজের মাতৃভাষা তাঁর প্রথম ভাষা, অভিবাসিত দেশের ভাষা হচ্ছে তাঁর লক্ষ্য-ভাষা বা দ্বিতীয় ভাষা৷) এই ব্যাপারটাকে বলে কালচারাল এসিমিলেশন বা সাংস্কৃতিক আত্মীকরণ৷

সাংস্কৃতিক আত্মীকরনের প্রথম ধাপ হচ্ছে লক্ষ্য-সংস্কৃতির লোকের প্রতি উদারতা। আমাদের বাঙালীদের যেটা হয় সেটা হচ্ছে বিদেশ গিয়ে প্রথমেই খুঁজে নেব দেশী ভাইবোন কে আছেন আশেপাশে! (আবার, দেশের অধিকাংশ মানুষই অন্য বাঙালীকে বিশ্বাসও করতে চায় না)। তাঁদের খুঁজে নিয়ে তাদের আশেপাশে থাকা, একটা কম্যুনিটি বানিয়ে ফেলা এতে অবশ্য নতুন অভিবাসীদের সাহস যোগায়। কিন্তু দিন শেষে আপনার সে দেশের সংস্কৃতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবেই। আর তাই আপনার উচিত সে দেশের লোকেদের সাথে মেশার চেষ্টা করা।

যদিও এটা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবারভেদে প্রজন্মের প্রজন্মের চেয়ে দ্বিতীয় প্রজন্ম সাংস্কৃতিক আত্মীকরণে বেশি সক্ষম হয়৷ পরিবারভেদে, কারণ অনেক পরিবারই তাঁদের সন্তানকে “অপসংস্কৃতির” লোকের সাথে মিশতে দিতে চান না। উল্টোটা হলে আমরা খুব তালি বাজাই৷ আমরাই খুশিতে গদগদ হয়ে যাই যখন বিদেশের একটা বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার নাম বাংলায় দেওয়া হয়৷ কিন্তু এই আমরাই ক্ষোভে ফেটে পড়বো যদি রোহিঙ্গারা ভাষানচরে গিয়ে ভাষানচরের নাম নিজেদের ভাষায় করতে চায়। (আমরা তো তাদের ভাষানচরেও যেতে দিতে চাই না।)

নিজের দেশের লোক যেখানে কম সেখানে পরবর্তী যে জিনিসটা কম্যুনিটি বানানোর ক্ষেত্রে মুখ্য হয়ে ওঠে সেটা হচ্ছে নিজের ধর্মের অন্য দেশের লোক। এখানে ঐতিহ্যগত পার্থক্য থাকলেও মানুষ এক সাথে মানিয়ে নেয় ধর্মের মিলের কারণে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ মুসলিম তাই তাদের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠে অন্যান্য দেশের মুসলিম অভিবাসী জনগোষ্ঠী।

নিজেদের এই আলাদা করে রাখার ফলে সাংস্কৃতিক আত্মীকরণ হয় না। এটা যেমন ভাষা শেখার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি সামাজিকতার ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। দুইটা সংস্কৃতির পার্থক্যকে স্বীকার করার প্রবণতা না থাকার কারণে, বা জাত্যাভিমানের কারণে আত্মীকরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পরের ধাপটা শুরু হয়- সাংস্কৃতিক সংঘাত (কালচারাল শক)। এই ধাপে জন্ম নেয় ভুল বুঝাবুঝি, ভয়, ঘৃণা আর শেষমেষ কারো রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অস্ত্র হিসেবে সহিংসতা৷ ক্রাইস্টচার্চের বর্বরতারও বহুমাত্রিক কারণ যেমন রয়েছে। এর শেকড় সন্ধান করতে গেলে দেখা যাবে ধর্ম, বর্ণ, জাত, এই তিনটি প্রধান জায়গায় অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং ক্ষমতালিপ্সুদের দ্বারা তার অপব্যবহারের পরিণতিতে যুগ যুগ ধরে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও আঘাত-পাল্টা আঘাতের ধারাবাহিকতা। ব্রেনটন উল্লেখ করেছে, ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোতে শ্বেতাঙ্গদের ভূমি ও জায়গা ক্রমশ দখল করে নিচ্ছে অভিবাসীরা, যাদের জন্মহার অনেক বেশি এবং যার ফলে হয়তো পশ্চিমা বিশ্বের শ্বেতাঙ্গরা এক সময়ে সংখ্যালঘু হয়ে মুসলমান ও অভিবাসীদের অধীনস্থতে পরিণত হবে। এতে বোঝা যায় ভুল উপলব্ধির ফলশ্রুতিতে একটা ভয়, তা থেকে ঘৃণা এবং ঘৃণা থেকে উৎপত্তি হওয়া হিংসা চূড়ান্ত পরিণতি ভয়াবহ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী।

এই জিনিস অভিবাসী আর অভিবাসিত দেশের লোক দুইয়ের মধ্যেই ঘটে। আপনি যত নিজেকে ওদের (যে দেশে অভিবাসী) সংস্কৃতি থেকে আলাদা করবেন ততই আপনার ভিন্নতা ওদের চোখে প্রকট হতে থাকবে৷ আপনাকে ওদের সংস্কৃতির অংশ হতে হবে না। তার মানে এটা নয় যে, আপনি আপনার পুরো সাংস্কৃতিক মূল্যাবোধকে ভুলে যাবেন বা অস্বীকার করবেন।) শুধু স্বীকার করুন সবারই নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। মেনে নিন ওদের সংস্কৃতি আপনার সংস্কৃতির মতই হাজার বছরের চলে আসা একটা প্রথা৷ আপনারটা আপনার কাছে সেরা, ওদেরটা ওদের কাছে। এতটুকু সহিষ্ণু হতে আপনার খুব বেশি একটা কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ওদের সাথে বসে মদ-পর্ক খেতে হবে না, তবে ওরা খায় খাক এতটুকু স্বীকার করে নিন। এক্ষেত্রে দায় আপনার বেশি। কারণ সেখানে আপনিই গেছেন, আপনাকেই তাদের সংস্কৃতিতে মানিয়ে নিতে হবে। কারণ ওদের দেশে ওদের সংস্কৃতি প্রাধান্য পাবে, সেটাই স্বাভাবিক।

আপনাকে একটি বিষয় বুঝতে হবে, অনুধাবন করতে হবে। সারা বিশ্বে যেভাবে রক্ষণশীল আর ডানপন্থীদের উগ্রতা বাড়ছে, এর মধ্যে ঘৃণা থেকে সহিংসতার জন্ম দিতে পারা লোক তাদের জনপ্রিয়তা আর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য সাংস্কৃতিক ঘাতে থাকা লোকেদের ব্যবহার করবে৷ আর একমাত্র, শুধুমাত্র, কেবলমাত্র- সহিষ্ণুতাই পারবে ঘৃণার অন্ধকারে জ্বালাতে পারবে ভালবাসার আলো।

একটা উদাহরণ দেই- ভারতের আম আদমি পার্টির সাবেক নেতা যোগেন্দ্র যাদব। দেশভাগের সময় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় তাঁর দাদাকে বিক্ষুব্ধ মুসলিমরা হত্যা করে। পুরো ঘটনাটা যোগেন্দ্রর ৭ বছর বয়সী বাবা দেখেন৷ ৭ বছরের বাচ্চা নিজের পিতাকে হত্যা হতে দেখেছে, তার উপর কেমন প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে হয়? যোগেন্দ্রর বাবার উপর যে প্রভাব পড়েছিল সেটা হচ্ছে তিনি সহমর্মি হয়েছিলেন। তাঁর একমাত্র ছেলের নাম রাখেন সেলিম। মানে যে মুসলিমদের হাতে তাঁর পিতা নিহত হন সে মুসলিমদের সংস্কৃতির নাম রাখেন নিজের ছেলের৷ পরে হাজার প্রশ্নের সামনে পড়া ছোট্ট সেলিম তাঁর বাবাকে অনুরোধ করেন নাম বদলে দিতে, সে থেকে সেলিম হয়ে যান যোগেন্দ্র। কিন্তু একটু ভাবুন, কতটুকু সহিষ্ণু হলে এমন কাজ করা যায়? আর নিজের ছেলেকে একই শিক্ষায় বড় করা যায়?

নিজের জীবনের জন্যে, অন্তত নিজের সন্তানের জীবনের জন্যে, পরের সংস্কৃতিকে মেনে নিতে একটু চেষ্টা করুন৷ পার্থক্য থাকবে এটা স্বীকার করে নিন। আপনি নিজের দায়টা পালন করুন, অন্যরাও এগিয়ে আসবে৷ হয়তো সময় লাগবে, অপেক্ষা করতে হবে। তবে দেরিতে হলেও, আসবে। আপনার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা যেন অন্যের মৃত্যুর কারণ না হয়। আসুন আমরা নিজেদের বিশ্বনাগরিক ভাবনার উন্মেষ ঘটাই। তাহলে পরের সংস্কৃতিকে সম্মান করার মূলবোধের বিকাশ হবে। যা অভিবাসী ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অধিকতর নিরাপদ করে তুলবে।

You may also like...

Read previous post:
কোরানে নারীদের নিয়ে অসম্মানসূচক আয়াত কেন? পর্ব- ১

নারীদের কে ইসলাম স্বাধীনতা দেয় না কেন?আল্লাহ যদি পুরুষ এবং নারী দুই সৃষ্টি করে থাকেন,তাহলে পুরুষদের উনি এক রকম এবং...

Close