আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাজনীতি তথা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকতে হয়। অন্যথায় সিন্দাবাদের ভুত চেপে বসে সরকারের ঘাড়ের উপর। সরকার হয়ে উঠে ক্ষুধার্ত বাঘের উপর সওয়ার। সিন্দাবাদের ভুত যখন সরকারের ঘাড়ে সওয়ার হয় তখন তারা দেশ পরিচালনায় মস্তিস্কের চেয়ে মর্জি নির্ভর হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে বিগত এক দশক ধরে তেমন পরিস্থিতি বিরাজমান।
আপনি তো বাংলাদেশের একজন নাগরিক। বাংলাদেশের আলো বাতাস খেয়ে, দেশের অর্থচক্রে ব্যবসা বা চাকুরির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে নিজের মতো জীবনযাপন করছেন। হয়তো আনন্দে আছেন, হয়তো কেটে যাচ্ছে কোনো রকম। কিন্তু আপনার চারপাশে কী ঘটেছে সেদিকে নজর দেয়ার সময় আপনার নেই। বিএনপিসহ বিরোধী দলের একের পর এক কর্মী গুম হচ্ছে, বাসা থেকে ধরে নিয়ে খুন করা হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ নেতা কর্মী কারাবন্দী। পকেটস্থ আদালতের রায় আর আইনশৃংখলা বাহিনীর পাশাপাশি হাতুড়িবাহিনী, হেলমেট বাহিনী বিরোধীপক্ষকে শায়েস্তা করছে। বিরোধীপক্ষ নিকেশের এই উৎসবে আপনি চুপ ছিলেন। অথবা আপনি নিরাপদে থাকতে চাইছেন । দশ বছরে বিএনপির ‘ঈদের পর আন্দোলন’ নিয়া ট্রল করা যাইতেই পারে ,জোর গলায় বলা যাইতেই পারে – ‘এদের মাজায় জোর নাই’… ইত্যাদি।
কিন্তু আজ? খুন করতে করতে খুনের নেশায় পেয়ে বসা এইসব লোকদের নির্যাতনের শিকার নিজ দলীয় লোকজন। কক্সবাজারের একরামুল অথবা গুলশানের সিসিটিভিতে দেখা মিল্কির খুন, এমপির হাতে নিজ দলের ইব্রাহিম খুন অথবা খোদ এমপি লিটন খুন। ঘটনা একেরপর এক। আর ভাবছিলেন চুপ করে থাকলে আপনি নিরাপদ থাকবেন? ক্যারিবিয়ান বংশোদ্ভুত মার্কিন কবি অদ্রে লর্ডে লিখছিলেন- ‘ইউর সাইলেন্স উইল নট প্রোটেক্ট ইউ’। আপনার হয়তো চোখে পড়েছে কিন্তু আপনি মনোযোগই দেননি।
আপনার গর্ভস্থ সন্তান গুলি খেয়েছে । আপনার ভাই আর বোন কোটা চাইতে গিয়া পিটুনি খেয়েছে। আপনার সন্তান নিরাপদ সড়কের দাবীতে রক্তাক্ত হয়েছে । আপনি উহ করলেই ডিজিটাল ধারায় আপনার জীবন শেষ হয়ে গেছে। আপনি বকেয়া বেতনের দাবী জানাইয়া মার খেয়েছেন। বাঘের সওয়ারী নিজ মর্জি মতো গ্যাসের দাম, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হইছে। দুনিয়াতে তেলের দাম যখন ইতিহাসের রেকর্ডপরিমান কম, তখন আপনার সরকার সর্বোচ্চ দামে আপনার কাছে তেল বিক্রি করছে। পরিবহন ভাড়া থিকা শুরু করে খাদ্যদ্রব্যের দাম আকাশে উঠে গেছে। কিন্তু আপনি কিচ্ছু করতে পারেননি।
বাসে নারী সহকর্মীর ধর্ষনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পরিবহণশ্রমিকের হাতে চড় থাপ্পড় খাইছেন। বাসায় ফেরার পথে রাস্তায় আপনার পকেটে গুইজা দেয়া হয়েছে ইয়াবা। আপনাকে বানিয়ে দেয়া হইছে মাদকব্যবসায়ী। রাস্তায় আপনাকে পিষে দিয়ে গেছে এমপি কিংবা ভিআইপির ছেলে। ধর্ম পালন করতে গিয়ে আপনি হইছেন জঙ্গী, নিধর্মী হতে গিয়া আপনি হইছেন কোপ খাওয়া নাস্তিক । আপনার পক্ষে দাঁড়াবার কেউই নাই, দাঁড়াবার মত যারা ছিল– তারা নিঃশেষ হইয়া গেছে আপনার অন্যসব সময়ের নীরবতায় ।
প্রয়োজনের সময় আপনার সরব উপস্থিতির, সরব সমর্থনের অভাবে আজ আপনি একা। আজ আপনার সাথে প্রশাসন নেই । দশ বছর ধরেই তারা নির্যাতিত আপনার পক্ষে দাঁড়ায়নি। আজ আপনার সাথে আইনশৃংখলা বাহিনী নেই। দশ বছর ধইরাই তারা ক্ষমতাসীনের পক্ষে ছিল। নির্যাতিতের বিরুদ্ধে ব্যবহ্নত হয়েছে তাদের বুলেট। তাদের ব্যাটন ব্যবহৃত হইছে নির্যাতকের পক্ষে। আজ আপনার পক্ষে আদালত নেই। দশ বছর ধরেই তারা শক্তিমানের পক্ষে একান্ত অনুগত হিসেবে কাজ করে গেছে। শক্তিমানের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে তাদের প্রধান বিচারপতিরও দেশ ছাড়তে হয়েছে। আজ আপনার পক্ষে বুদ্ধিজীবিরা নেই । দশ বছর ধরে তাদের কলম থেকে কালির বদলে নিঃসৃত হইছে তেল। যা অত্যাচারীর পক্ষে আর আপনার স্বার্থের বিরুদ্ধেই ছিল।
আজ আপনার পক্ষে সেনাবাহিনীও নেই। মুর্তির মতো তারা খালি অবলোকনই করে গেছে। মূর্তি ঠিক রাখতে গিয়ে তারা ভাবমূর্তি খোয়াতে গা করেনি।
আজ আপনার পক্ষে আছে শুধু মাত্র আপনি ও আপনার একটি মাত্র ভোট। একটা ব্যালট পেপার। যার এতই ক্ষমতা যে এটা আপনে প্রয়োগ করুন– এইটা ওরা চায় না! ওরা কারা জানেন তো? নাকি সেটাও রয়ে গেছে আপনার বেখেয়ালে? সুতরাং ৩০ শে ডিসেম্বর সকালেই ভোটকেন্দ্রে যান। আপনার ব্যালটের ক্ষমতা প্রয়োগ করুন।
বাকি জীবন ‘কি হইলে কি হইতো’ বলে আফসোস কইরেন না। এই মূহুর্তে আপনার ভবিষ্যত আপনারই হাতে, ঐ এক টুকরা ব্যালটে।
ব্যালটে বিশ্বাস রাখুন। মনে রাখেন বুলেটের চেয়ে ব্যালট বড়। আপনার এই যে বেখেয়ালীপনা, নির্লিপ্ততা, নিরাপত্তার স্বার্থে নিরবতা তা আপনাকে কোনওভাবেই নিরাপদে রাখবে না। বরং আপনার নিরাপত্তাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা দানবের শক্তি বাড়বে। দানব কিন্তু সেটাই চায়। যেন আপনি বেখেয়ালে থাকেন, নিজের নিরাপত্তা ভাবনায় মশগুল থাকেন। শেষ করছি জার্মান কবি মার্টিন নিম্যোলার এর একটি কবিতা দিয়ে-
“যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল, আমি কোনো কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল, আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে,আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,
কারণ আমি ইহুদি নই।
আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,
কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বলল না, কারণ, কথা বলার মত তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।”