অনেকে মনে করেনযে, ইসলাম নারীদের নেতৃত্ব ‘হারাম’ করে নারীদের ক্রিয়েটিভিটি দেখানোর কোনো সুযোগ দেয়না। এই ধরনের মন্তব্য আজকালকার সেক্যুলার সমাজে ইসলাম না জানা মানুষের মধ্য থেকেওঠা নতুন কিছু নয়। এতে অবাক হবারও কিছু নেই।
‘পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’ – নারী ও পুরুষকে এমন সমতার চোখেই দেখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি বিগত তিন দশক ধরে পরিচালিত হচ্ছে দুই নারীর নেতৃত্বে। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? বাংলাদেশে বিশেষত রাজনীতিতে নারীদের অবস্থান কোথায়?
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির একটি বিধি রয়েছে নির্বাচন কমিশনের বিধিমালায়। রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্ত পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সে অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বস্তরের কমিটিতে যে সংখ্যায় নারী সদস্য অন্তর্ভুক্তির বাধ্য-বাধকতা রয়েছে তা এখনো পর্যন্ত কোনো দলই পূরণ করতে পারেনি। আর প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ দেখা গেলেও, ইসলামী দলগুলোতে তা নেই বললেই চলে। পরিস্থিতি পরিবর্তনের তেমন কোনো লক্ষণও দৃশ্যমান নয়।
নারীদের অংশগ্রহন বৃদ্ধির সেই বিধি পূরণে দলগুলোর হাতে সময় আছে আর তিন বছর। সময় বেঁধে দেবার বিষয় নিয়ে কী বলছে ইসলামী দলগুলো? কিন্তু আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতো দলে নারীদের অংশগ্রহণ থাকলেও কুড়ি শতাংশের ওপরে নয়। যদিও দলগুলোর নেতৃত্বের শীর্ষ পদে রয়েছেন নারী। সবেচেয়ে খারাপ অবস্থা ধর্মভিত্তিক ইসলামী দলগুলোর। খেলাফতে মজলিস নামে দলটির কেন্দ্রীয় বা তৃণমূলের কোনো কমিটিতেই কোনো নারী সদস্য নেই। খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব শেখ গোলাম আসগর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমাদের দলে মহিলা মজলিস নামে একটি ইউনিট আছে। আমরা সেখান থেকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারীদের আনতে চাইছি।’ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় কমিটিতে এখনও স্থান হয়নি নারীদের। দলটির সারাদেশে সদস্য সংখ্যা প্রায় দশ হাজারের মতো। তার দুই শতাংশ নারী সদস্য বলে তারা দাবি করেন। সারাদেশে সদস্য সংগ্রহের কাজ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। কিন্তু ইসলামী দলগুলোতে তারা কতটা ভূমিকা রাখতে পারছেন? শেখ আসগরের মতে, ‘তারা ঘরোয়াভাবে নারী সদস্য সংগ্রহ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছেন।’ সভা সমাবেশে তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে ইসলামী দলগুলো এখনো সরব নয়। শেখ আসগর বলেন- ‘পুরুষরাই তো নেতৃত্ব দেবেন। নারীরা পুরুষদের সহযোগী। মহিলাঙ্গণে মহিলারা নেতৃত্ব দেবেন। আমাদের পলিসিটা সেটাই। সভা সমাবেশে তাদের যাওয়ার দরকার নেই।’
রাজনৈতিক দলগুলোকে ২০২০ সালের মধ্যে সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। নিবন্ধিত ৪০টি দলের কাছে ‘নারী প্রতিনিধিত্ব অন্তর্ভুক্তির’ সর্বশেষ তথ্য চেয়ে তাগিদ দেয় ইসি। দেশে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামী ধর্মভিত্তিক দল ১১টি। এদের মধ্যে এমন দলও আছে যাদের কেন্দ্রীয় বা তৃণমূলের কোনো কমিটিতেই কোনো নারী সদস্য নেই।
ইসলামী ঐকজোটের নারী সদস্য সংখ্যা এক শতাংশেরও নিচে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এমন প্রেক্ষাপটে আগামি তিন বছরের মধ্যে শর্ত পূরণ করা কতটা সম্ভব? ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ তাদের দলে নারী সদস্য সংখ্যা জানাতে পারেননি। তবে তারা এ বিষয়ে কাজ করছেন বলে দাবি করেছেন।
সবচেয়ে দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগেও কুড়ি শতাংশের ওপরে নারী সদস্য নেই। বিএনপি, জাতীয় পার্টিতে তা আরও কম। আওয়ামী লীগ নেতা নুহ উল আলম লেলিন বলেছেন- ‘বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্যান্য ক্ষেত্রে নারীদের অংশ দিন দিন বাড়লেও, সক্রিয় রাজনীতিতে নারীদের নিয়ে আসা এখনো চ্যালেঞ্জ।’ নির্বাচন কমিশন সচিব মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ জানান, এখনও পর্যন্ত ষোলোটি দল তাদের চিঠির জবাব দিয়েছে। দলগুলো নারীদের অংশগ্রহণের এই শর্ত পূরণ না করলে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পূরণ করেত না পারলে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাববে কমিশন।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টসহ ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে তাদের দলে নারী ইউনিট থাকার কথা বলা হলেও সেসব দলের রাজনীতিতে নারীরা সক্রিয় নন। আর যারা আছেন তারা সভা-সমাবেশে বা রাজপথের আন্দোলনে অংশ নেন না। সেই মানসিকতাও ইসলামী দলগুলোর মধ্যে এখনো গড়ে ওঠেনি। তাদের কার্যক্রম ঘরোয়াভাবে নারী সদস্য সংগ্রহ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে রাজনীতিতে নারীর নেতৃত্ব বা ক্ষমতায়নের যে কথা বলা হচ্ছে সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের এই বাধ্য-বাধকতা কতটা ভূমিকা রাখবে সেটাই দেখার বিষয়। অবশ্যই এই দেখার বিষয় কথাটির মধ্যে এক ধরনের নির্লিপ্ততা আছে। এখন প্রয়োজন জাগরণের।