মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়েছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট নাজিমুদ্দিন সামাদের। তিনি মুঠোফোনে বলেছিলেন, প্রিয় ছোট্ট ভাগ্নের জন্য সাইকেল কিনে রাত পোহালেই বৃহস্পতিবার বাড়ি আসবেন। এ খবরে ভাগ্নের খুশিতে বাড়ির সবার মধ্যেই ছিল অন্যরকম এক আনন্দ। কিন্তু মামার কাছ থেকে সাইকেল পাওয়ার অপেক্ষা আর ফুরাবে না ভাগ্নের, ঘাতকদের ধারালো অস্ত্র সে অপেক্ষার সমাপ্তি টেনে দিয়েছে নিদারুণভাবে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সামাদের পরিবারে এখন কান্নার সুর, বিষাদের ছাপ।
এই বিষণ্ন পরিবারের মতো অবস্থা প্রায় প্রতিটি নিহত ব্লগার পরিবারের। এ পরিবারের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। দুর্বৃত্তদের হাতে অকালে প্রাণ দিচ্ছেন মুক্তচিন্তার মানুষ। ঘটনার পর নিয়ম করে মামলা হচ্ছে, আটকও হচ্ছেন দু-চার জন সন্দেহভাজন। কিন্তু বিচার হচ্ছে না কোনো ঘটনারই। এসব মামলার অগ্রগতিসংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি বলছে, গত তিন বছরে সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন আটজন ব্লগার, যার মধ্যে গত ১৪ মাসে হত্যা করা হয়েছে ছয়জনকে। ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আহমেদ রাজীব হায়দারকে দিয়ে এ হত্যাকাণ্ডের শুরু। আর গত বুধবার রাত ৯টার দিকে বাসায় ফেরার সময় ঢাকার সূত্রাপুরের একরামপুরে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন বিভাগের ছাত্র ২৭ বছর বয়সী নাজিমুদ্দিন সামাদকে। খুনিরা এতটাই ভয়ঙ্কর— কখনো ছদ্মবেশে, কখনো দীর্ঘ সময় ধরে ওত পেতে থেকে, কখনো টার্গেটে থাকা ব্লগারের বাসার গেটের সামনে অস্ত্র নিয়ে বসে থাকে। বাসার সামনে, রাতে দিনে প্রকাশ্যে তারা খুন করে পালিয়ে যাচ্ছে। বাসার বেডরুমে ঢুকে খুন করেও তারা লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে। আবার অফিসে ঢুকে খুনের পর বাইরে থেকে তালা মেরেও গাঢাকা দিচ্ছে খুনিরা। একের পর এক এমন নৃশংস খুনের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ব্লগাররা। মৃত্যু যেন তাদের তাড়া করে ফেরে প্রতিনিয়ত। এতে পাল্টে গেছে তাদের চলার রুটিন। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন সব সময়। ব্লগে লেখালেখি ও ঢাকার গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকায় তারা বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকি পাওয়ায় দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। এ মুহূর্তে আতঙ্কিত ব্লগার ও তাদের উদ্বিগ্ন স্বজনদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে— এর পরের টার্গেট কে?
নিহত পরিবারদের অভিযোগ, এসব হত্যাকাণ্ডের প্রতিটির জন্যই কোনো না কোনো ধর্মীয় ও মৌলবাদী সংগঠন দায় স্বীকার করেছে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোই পুলিশের সন্দেহের তালিকায়। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বার বার ‘তদন্ত চলছে, আসামি ধরা পড়বে, বিচার হবে’ এমন বক্তব্যই আসছে। কিন্তু বাস্তবে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা আর নতুন খুনের ঘটনা একটি আরেকটিকে চাপা দিচ্ছে। ফলে কোনো ব্লগার হত্যার বিচারই এখনো আলোর মুখ দেখেনি বলা যায়। পুলিশ ও গোয়েন্দারা বলছেন, এসব খুনের সঙ্গে ধর্মান্ধ ইসলামী মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠন জড়িত। অনেককেই গ্রেফতার করে আইনের মুখোমুখি করা হয়েছে। যাদের এখনো গ্রেফতার করা যায়নি, তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
অভিজিৎ হত্যার তদন্তে নেই অগ্রগতি : গেল বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে, মারাত্মক আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা হয়। মামলার সন্দেহভাজন আসামি আটজন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ২ মার্চ যাত্রাবাড়ী থেকে শফিউর রহমান ওরফে ফারাবী নামের একজনকে গ্রেফতার করে ডিবিতে হস্তান্তর করে র্যাব। কিন্তু এ মামলার আর অগ্রগতি নেই। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের কেউই এখনো আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি। পুলিশ জানিয়েছে, অভিজিত হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থল থেকে ১১টি আলামত এফবিআই নিয়ে যায় পরীক্ষার জন্য। তাদের ফরেনসিক পরীক্ষার রিপোর্ট এখনো হাতে না পাওয়ায় অভিজিৎ হত্যার তদন্ত ধীরগতিতে চলছে।
দীপন হত্যার তদন্তে ভাটা : ৩১ অক্টোবর রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলার ১৩২ নম্বর দোকানে জাগৃতি প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। একই দিনে তারা হত্যার চেষ্টা চালায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক টুটুল, লেখক রণদীপম বসু ও কবি তারেক রহিমকে। এসব ঘটনার মামলা তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই।
ওয়াশিকুর হত্যা বিচারের গতি শ্লথ : অভিজিৎ হত্যার এক মাসের মধ্যেই গত বছর ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁওয়ে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে। ঘটনার পর পালানোর সময় কয়েকজন হিজড়া, স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ মিলে জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম নামের দুজনকে ধরে ফেলেন। এদের একজন পরে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ মামলায় পাঁচজনকে আসামি করে ১ সেপ্টেম্বর পুলিশ অভিযোগপত্র জমা দেয়। যাদের তিনজন বর্তমানে কারাগারে আটক, বাকি দুজন পলাতক রয়েছেন।
সিলেটের বিজয় হত্যা মামলার শুনানিই শুরু হয়নি : গত বছর ১২ মে সকালে সিলেটের সুবিদবাজারের নুরানি আবাসিক এলাকায় খুন হন ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। এ ‘মুক্তমনা’ ব্লগার সিলেট থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞানবিষয়ক একটি পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। ঘটনার দিন রাতে এলাকার বিমানবন্দর থানায় হত্যা মামলা হয়। সপ্তাহ তিনেক পর মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) স্থানান্তর করা হয়। তদন্তে নেমে সিআইডি ইদ্রিস আলী নামের স্থানীয় এক ফটোসাংবাদিককে আটক করে রিমান্ডে নেয়। তিনি বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।
চাপা পড়ছে নীলাদ্রি হত্যা মামলা : গত বছরের ৭ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁওয়ে খুন হন ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় ওরফে নিলয় নীল। এ মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক চারজনের মধ্যে দুজনকে গত ২৭ আগস্ট পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। এরপর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি মামলাটির। যেন একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনায় চাপা পড়েছে নিলয় হত্যা মামলা। তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বলেও জানান তদন্ত কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান।
বিচারাধীন আরও দুই মামলা : বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরিফ রহমান হত্যা ও ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন হত্যাচেষ্টা মামলায় করা দুটি মামলাও বিচারাধীন রয়েছে। ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। পরের পছর ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর মামলাটির অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। তার পর থেকে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। একই বছরের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরিফ রহমানকে হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালের ১৬ মার্চ অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তিকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া মামলাটিও এখন আদালতে বিচারাধীন।
রাজীব হত্যার রায় প্রত্যাখ্যান : যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন উত্তাল শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ, ঠিক তখনই ১৫ ফেব্রুয়ারি দুর্বৃত্তের চাপাতির আঘাতে পল্লবীতে নিজ বাসার সামনে খুন হন আন্দোলনে অংশ নেওয়া কর্মী আহমেদ রাজীব হায়দার। ব্লগে তিনি ‘থাবা বাবা’ নামে লিখতেন।
ব্লগার ও প্রকৌশলী রাজীবকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করার কথা স্বীকার করে আসামিরা আদালতে জবানবন্দি দিলেও সব আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। এ কারণে রায় প্রত্যাখ্যান করেছে রাজীবের পরিবার ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। ব্লগার হত্যাকাণ্ডের মামলায় গত ৩১ ডিসেম্বর প্রথম রায় ঘোষণা করা হয়। নিহত রাজীবের বাবা বলেছেন, এ রায় প্রভাবিত। তিনি বলেন, ‘সব আসামি মিলে পরিকল্পনা করে হত্যা করেছে আমার ছেলেকে। প্রত্যেকের কেন ফাঁসি হবে না?’ মামলায় আট আসামির মধ্যে দুজনকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এক আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
বিচারহীনতায় হতাশ স্বজনরা : ব্লগার বা মুক্তমনের লেখক হত্যার বিচারের এ দশা পরিবার ও স্বজনদের মাঝে হতাশাই ছড়াচ্ছে। যে কারণে প্রকাশক দীপন হত্যার পর তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছিলেন, ‘আমি কোনো বিচার চাই না।’ এ একই কথা বলেছেন নিহত ব্লগার অভিজিতের স্ত্রীও। তিনি ব্লগে লিখেছেন, ‘দীপনের বাবার মতো আমিও বিচার চাই না।’
দেশত্যাগ : রাজীব, অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয়, ওয়াশিকুর বাবুসহ ব্লগাররা একের পর এক খুনের পর দেশত্যাগ করতে শুরু করেন ব্লগাররা। জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৩০ জনের বেশি ব্লগার দেশ ছেড়েছেন। তাদের মধ্যে ২০ জন যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইডেনসহ ইউরোপের দেশগুলোয় রয়েছেন। বাকিরা পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানান, অভিজিৎ রায়ের হত্যার পর শুরু হয় ব্লগারদের দেশছাড়ার প্রক্রিয়া।
সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন