দেখতে টোকায়ের মত মনে হলেও সে আসলে ছাত্র, তাও আবার ঢাকা কলেজের ছাত্র! সে ঢাকা কলেজ মনোবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র! তার নাম ইব্রাহীম। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহবায়ক এই হামলাকারী। সবাই শেয়ার করে তাকে বিচারের আওতায় আনতে সাহায্য করুন।
সেদিন কি ঘটেছিল
পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় রাজধানীর সাইন্সল্যাব এলাকায় সাংবাদিকদের ওপর ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। হামলায় আহত ও দায়িত্বপালনকারী সংবাদকর্মীরা জানান, রবিবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত সায়েন্সল্যাব, সিটি কলেজ, ধানমন্ডি ২ নম্বর ও জিগাতলা এলাকায় তাদের ওপর চড়াও হয়ে ক্যামেরা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। কারো কারো ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়েছে। তাদের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়া হয়েছে। হুমকি-ধমকি দিয়ে দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার পাশাপাশি ছবি তুললে মারধর করা হবে বলে শাসানো হয়েছে। এতে আতঙ্কগ্রস্ত সংবাদকর্মীরা নিরাপত্তার স্বার্থে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ-যুবলীগের চড়াও হওয়ার ছবি তুলতে পারেননি।
প্রত্যক্ষদর্শী সংবাকর্মীদের ভাষ্য, ঢাকা কলেজ থেকে আসা ছাত্রলীগের একটি মিছিলের সামনে থাকা সাত যুবক প্রথম সংবাদকর্মীদের ওপর হামলা চালান। তাদের সবার মাথায় হেলমেট ছিল। হাতে ছিল রড, লাঠি ও চাপাতি। তারা যাকেই ছবি তুলতে দেখেছেন তাদের ওপরই হামলা করেছেন। হামলাকারীদের নেপথ্যে থেকে মদদ দিয়েছেন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ শাখার সাবেক আহ্বায়ক শিহাবুজ্জামান শিহাব ও সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন।
যোগাযোগ করা হলে শিহাবুজ্জামান শিহাব অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘আজ এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। আপনি দেখেন, কোথাও সাংবাদিকদের ওপর হামলায় আমাকে পাবেন না। আমার ছেলেপেলেরা কেউ করেনি। আমি থাকা অবস্থায় আমার সামনে কেউ সাংবাদিকদের গায়ে হাত তোলেনি।’
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক এই সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, ‘আজ দুপুরে সেন্ট্রাল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী গণভবন থেকে ফিরছিলেন। ল্যাবএইড হাসপাতালের উল্টো দিকে তার সঙ্গে থাকা একটি মোটরবাইক পুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি অন্যদের মারধর করো হয়েছে। এই মেসেজ কলেজে (ঢাকা) যাওয়ার পর কলেজের নেতাকর্মীরা ল্যাবএইড পর্যন্ত মহড়া দিয়েছে। কিন্তু কারো গায়ে হাত তোলেনি।’
রবিবার দুপুরে সায়েন্সল্যাব থেকে ধানমন্ডি ২ নম্বর হয়ে জিগাতলা পর্যন্ত অন্তত দশজন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়ে আহত হন। এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকজন হামলার শিকার হলেও তাদের অবস্থা ততটা গুরুতর নয়। হামলায় আহত হয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এপি’র (অ্যাসোসিয়েট প্রেস) ফটোসাংবাদিক এ এম আহাদ, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আহমেদ দীপ্ত, পাঠশালার দুই শিক্ষার্থী রাহাত করীম ও এনামুল কবীর হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
এছাড়া আহত অন্য সাংবাদিকরা হলেনন দৈনিক বণিকবার্তার পলাশ শিকদার, অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিমর্নিংয়ের আবু সুফিয়ান জুয়েল, দৈনিক জনকণ্ঠের জাওয়াদ, প্রথম আলোর সিনিয়র ফটোগ্রাফার সাজিদ হোসেন, চ্যানেল আইয়ের সামিয়া রহমান, মারজুক হাসান, হাসান জুবায়ের ও এন কায়ের হাসিন।
এ এম আহাদের সঙ্গে হামালার শিকার হন দৈনিক বণিকবার্তার ফটোসাংবাদিক পলাশ শিকদার। তিনি বলেন, ‘দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটের দিকে আমি, আহাদ ভাই ও একটি অনলাইনের ফটোসাংবাদিক সায়েন্সল্যাব ওভারব্রিজের নিচে ছিলাম। এসময় ঢাকা কলেজের দিক থেকে ছাত্রলীগের একটি মিছিল আসে। মিছিলের সামনে ছয়-সাতজন ছাত্র হাতে জিআই পাইপ নিয়ে প্রথমে আমাদের ওপর চড়াও হয়। এসময় আহাদ ভাইয়ের মাথা ফেটে যায়। আমরা দৌঁড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে দুজন নার্স রাস্তাতেই আমাদের সহযোগিতা করছিল। এসময় ছাত্রলীগের ছেলেরা আরেক দফা এসে আহাদ ভাইকে পেটাতে থাকে। আমাকেও টেনে নিয়ে পেটানো শুরু করলে আমি দৌঁড়ে রাস্তার ওপারে চলে যাই।’
পলাশ শিকদার বলেন, ‘মাথা হেলমেট পড়া যুবকরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আহাদ ভাইয়ের কোমড় থেকে বেল্ট কেটে নিয়ে ক্যামরো ভেঙে ফেলে। তাকে মারধরের পর একজন রিকশাওয়ালা আহাদকে তুলে নিয়ে এগিয়ে আসলে আমিসহ চিৎকার করে মানুষের সহযোগিতা চাই। কিন্তু কেউ আমাদের সহযোগিতা করেনি। এমনকি পুলিশও আমাদের ডাকে এগিয়ে আসেনি।’
তিনি বলেন, ‘আহাদ ভাইকে নিয়ে ল্যাবএইডে নিয়ে গেলে তারা প্রথমে ভর্তি করাতে চায়নি। এসময় আমি কান্নাকাটি করি।এরপরও হাসপাতালে ঢুকতে দিতে চায়নি।পরে ঢাকা ট্রিবিউনের ফটোসাংবাদিক মেহেদী এগিয়ে এসে জোর করে ল্যাবএইডের জরুরি বিভাগে ঢোকায়।’
প্রায় একই সময়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আহমেদ দীপ্ত। হামলার পরপরই তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, দুপুর ২টার দিকে তিনি সায়েন্সল্যাব ফুটওভার ব্রিজের নিচে শিক্ষার্থীদের অবস্থান দেখতে এগিয়ে যান। এসময় অতর্কিতে ব্রিজের নিচে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী লাঠিসোঁটা নিয়ে তার ওপর চড়াও হয়। বেধড়ক পেটানোর পর অন্য সহকর্মীরা তাকে উদ্ধার করেন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আহমেদ দীপ্তর পিঠ ও হাতসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তবে তার অবস্থা আশঙ্কামুক্ত। এ এম আহাদের মাথা ফেটে গেছে। তার মাথায় বেশ কয়েকটি সেলাই দিতে হয়েছে। তিনিও এখন আশঙ্কামুক্ত।
ছাত্রলীগের বেধড়ক মারধরের শিকার হয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ফটোগ্রাফি বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাঠশালার শিক্ষার্থী ও ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার রাহাত করীম। দুপুর ২টার দিকে সায়েন্সল্যাবের ফুটওভার ব্রিজের নিচে তাকে মারধর করা হয়। এ ঘট্নার একটি ভিডিও ফুটেজ রয়েছে বাংলা ট্রিবিউনের হাতে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ফটোসাংবাদিক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, দুপুর ২টার পরপরই ঢাকা কলেজের দিক থেকে আসা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যখন সায়েন্সল্যাবের দিকে আসে, তখন রাহাত করীম ফুটওভার ব্রিজের দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন। এসময় লাঠি হাতে যুবকরা প্রথমে তার দিকে ইট-পাটকেল ছোড়ে। এসময় ফুটওভার ব্রিজের ওপরে আরও অন্তত ১০-১২ জন ফটোগ্রাফার ছিলেন। রাহাত নিচে নেমে আসলে তার ক্যামেরা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু রাহাত ক্যামেরা না ছাড়ায় তাকে মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাকে মারতে মারতে গেঞ্জি ছিঁড়ে ফেলা হয়। তার মাথা ফেটে রক্ত বের হলে নেতাকর্মীদের কয়েকজন এগিয়ে এসে অন্যদের থামায়।
পাঠশালার প্রিন্সিপাল আবীর আব্দুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাহাত করীমসহ মোট পাঁচজন শিক্ষার্থী ও ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার হামলার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে রাহাতের অবস্থা একটু গুরুতর। তার মাথায় সেলাই দিতে হয়েছে। এনামুল করীম নামে আরেকজনের পা পিটিয়ে থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। তাকে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখান থেকে তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’
ছাত্রলীগের বেপরোয়া হামলার সময় ল্যাবএইডের উল্টো দিকে ধানমন্ডি ৩ নম্বর সড়কের পাশে হ্যাপি আর্কেডের সামনে অবস্থান নেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। দুপুর ২টার একটু পর ঘটনাস্থলে থাকা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অপরাধ বিষয়ক প্রধান প্রতিবেদক লিটন হায়দার বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সায়েন্সল্যাবের দিক থেকে ধাওয়া দিলে আমরা দৌঁড়ে এসে হ্যাপি আর্কেডের সামনে এসে অবস্থান নিই। এসময় ছাত্রলীগের ছেলেরা আমাদের ওপর চড়াও হয়। তারা দূর থেকে আমাদের ওপর বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেলও নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে ওরা লাঠিসোঁটা ও চাপাতি হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে। আমাদের সেখান থেকে চলে যেতে বলে এবং কোনও ছবি তুলতে নিষেধ করে।’
ঘটনাস্থলে উপস্থিত দৈনিক সমকালের স্টাফ রিপোর্টার বকুল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের ওখানে একাত্তর টিভি, যমুনা ও বৈশাখী টেলিভিশনের সংবাদকর্মীরাও ছিলেন। তারা (ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা) আমাদের ছবি তোলার জন্য শাসাচ্ছিল। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে লাঠির পাশাপাশি ধারালো অস্ত্রও ছিল। অবস্থা এমন ছিল ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে গেলেই তেড়ে আসছিল। অনেকের মোবাইল-ক্যামেরাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’
ধানমন্ডি ২ নম্বর সড়কে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাছে হেনস্তার শিকার হন চ্যানেল আইয়ের রিপোর্টার সামিয়া রহমান। সেখানে বেশ কয়েকজন ফটোসাংবাদিক ও রিপোর্টার উপস্থিত ছিলেন। এই প্রতিবেদক নিজেও সেখানে অবস্থান করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হুমকি-ধমকি প্রত্যক্ষ করেন। ঘটনাস্থলে থাকা ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের স্টাফ রিপোর্টার মুক্তাদির রশীদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “হেলমেট পরিহিত ছাত্রলীগ পরিচয়ধারীরা এসে বলে, ‘আজকের সব কিছুর সমস্যার মূলে সাংবাদিকরা।’ তারা ধারালো অস্ত্র নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে এসে বলে, ‘কেউ ছবি তুলবি না।’ ‘সব ক্যামেরা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেল’ বলে ধমকাচ্ছিল। যেসব ছাত্রলীগ নেতারা আশপাশ দিয়ে যাচ্ছিল তারা সবাই তেড়ে আসার পাশাপাশি অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছিল এবং ধমকাচ্ছিল। তারা বলছিল, ‘কালকে যদি কোনও ছবি দেখি কাউকে ছাড়বো না।’ এর ভেতরে একজন বলে ওঠে, ‘একজন যদি ছবি তোলে সবাইকে কোপাবো।’ তবে পুলিশের খুব কাছাকাছি হওয়ায় তারা জিগাতলার দিকে যেতে থাকে। উপায়ন্তর না দেখে পুলিশ সাংবাদিকদের সরে যেতে অনুরোধ করে।”
হামলার শিকার হওয়া অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডি মর্নিংয়ের আবু সুফিয়ান জুয়েল বলেন, ‘হামলাকারীরা সবাই ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মী বলে আমারা জানতে পেরেছি। তাদের অনেকের মাথায় হেলমেট ছিল।’
নাগরিক টিভির গাড়ি ভাঙচুর করেছে আন্দোলনকারীরা
দুপুর ১টার দিকে ঢাকা সিটি কলেজের সামনে নাগরিক টিভির একটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। নাগরিক টিভির ক্যামেরাম্যান রিপন হাসান জানান, দুপুর ১টার দিকে তারা ঢাকা সিটি কলেজের সামনে অবস্থান করছিলেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যখন মিছিল নিয়ে জিগাতলার দিকে যাচ্ছিল, তখন একদল যুবক আমাদের গাড়িটিতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। আমরা সঠিক তথ্য প্রকাশ করছি না— এই অভিযোগে হামলা করে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব সোহেল হায়দার চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ। সমাজের যা কিছু ভালো-মন্দ বা শুদ্ধ-অশুদ্ধ তা তুলে ধরে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা কখনও কাম্য হতে পারে না। এটি গণতন্ত্র ও সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে।’
তিনি বলেন, ‘সব সরকারের সময়েই সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালানো হয়। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাংবাদিকবান্ধব। সেই আওয়ামী লীগের আমলে যখন এ ধরনের ঘটনা দেখি এবং হামলার সুষ্ঠু বিচার না হতে দেখি, তখন মর্মাহত হই। হামলাকারীরা যে দেলেরই হোক তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানাই।’
সাংবাদিকদের মারধরের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মারুফ হোসেন সরদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে কেউ এমন কোনও অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই আমরা মামলা নেবো এবং আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।’