বিডিয়ার বিদ্রোহ : তদন্ত কমিটির রিপোর্টে ও হত্যাকান্ডে আওয়ামীলীগ জড়িত

পিলখানাস্থ বিডিআর হেডকোয়ার্টার্সে সংঘটিত বিদ্রোহ এবং নৃশংস হত্যাকান্ড তদন্তে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন যা সুস্পস্ট ভাবে প্রমান করে এই হত্যাকান্ডে আওয়ামীলীগ জড়িত। উল্লেখযোগ্য অংশগুলো দেওয়া হলো।
১) তদন্তের স্বার্থে এ কমিটি কয়েকটি সংস্থার প্রধান, কতিপয় গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নিকট হতে গোয়েন্দা তথ্যসংগ্রহ করা আবশ্যক বলে মনে করেছে। কিন্তু পর্যাপ্ত সহযোগিতার অভাবে একাজগুলো করা সম্ভব হয়নি। ফলশ্র“তিতে, পর্যাপ্ত তথ্য প্রমানসহ এ বিদ্রোহ এবং হত্যাকান্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারীদের সনাক্ত করা এবং ঘটনার পেছনের মূল কারণ বা মোটিভ উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। কমিটি সংশিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ যেমন এনএসআই, ডিজিএফআই, র‌্যাব, সিআইডি ও পুলিশের এসবিকে তাদের সংগৃহীত বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য ও প্রয়োজনীয় প্রমানাদি পেশাগত দৃষ্টিকোন থেকে বিশে−ষন করে কমিটির নিকট সরবরাহ করার জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু বর্ণিত সংস্থাসমূহ হতে ঈপ্সিত সহযোগিতা পাওয়া যায় নি। যেহেতু এ কমিটির কাছে সত্য উদঘাটনের জন্য সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করার উপযুক্ত উপকরন, প্রযুক্তি এবং কৌশল ছিল না, তাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কমিটির নিকট উপস্থাপিত বা আনীত প্রায় সবাই কোন প্রকার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা প্রমান দেয় নি। ফলশ্র“তিতে কমিটির নিকট এটা প্রতীয়মান হয়েছে যে, বিডিআর এর বিদ্রোহের ঘটনায় প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী ও পেছনের পরিকল্পনাকারীদের চিহ্নিত না করা পর্যন্ত এ ঘটনার পেছনের কারণ ও উদ্দেশ্য বের করা একটি দুরূহ ও সময়-সাপেক্ষ কাজ।
২) ৬.১ বিদ্রোহের পরিকল্পনা তদন্তে সহায়তাকারী একটি সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে (সংযোজনী-৭) ২৫ ও ২৬ ফেব্র“য়ারী তারিখের হত্যাকান্ড, লুটতরাজ ও অন্যান্য অপরাধের পরিকল্পনার সাথে বিডিআর এর অনেক সদস্যসহ আরো অনেক বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ জড়িত ছিল বলে প্রকাশ। একই সূত্রমতে, প্রায় ২ মাস যাবত এ পরিকল্পনার কাজ চলে। পরিকল্পনার বিভিন্ন পর্যায়ে ষড়যন্ত্রকারীরা ঘটনার পূর্ব পর্যন্ত বেশ কিছু বৈঠক করে। এসব বৈঠকের
তথ্যাবলী নিম্নরূপ:
ক) নির্বাচনের পূর্বে বিডিআর এর বেশ কিছু সদস্য ব্যারিষ্টার তাপস (বর্তমানে সাংসদ) এর অফিসে যান। এদের মধ্যে উলে−খ্য, হাবিলদার মনির,সিপাহী তারেক, সিপাহী আইয়ুব, ল্যা: না: সহকারী সাইদুরসহ ২৫/২৬ জোয়ান ও জনৈক জাকির সেখানে উপস্থিত ছিল।
খ) নির্বাচনের ৩/৪দিন পর পরিকল্পনা সংশি−ষ্ট কয়েকজন বিডিআর সদস্য এমপি তাপসের বাসভবন “স্কাই ষ্টার” এ যায়। সেখানে তাঁকে দাবী পূরণের কথা বলা হলে তিনি রেশনের বিষয়টি ছাড়া অন্য কোন বিষয় বিবেচনায় আনা সম্ভব নয় বলে জানান।
গ) ফেব্র“য়ারী মাসের মাঝামাঝি সংসদ সদস্য জনাব শেখ সেলিমের বাসায় ২ জন ডিএডি এবং বেসামরিক জাকিরের নেতৃত্বে ১০/১২জন বিডিআর সদস্য সাক্ষাৎ করে। এমপি জনাব সেলিম জানান যে, এসব দাবী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের বিষয়, তবে তিনি তার একটি লিখিত কপি চান।
ঘ) পরবর্তীতে এ দলটি মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথেও দেখা করার জন্য সচেষ্ট হয় বলে জানা যায়।
ঙ) রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে দাবী-দাওয়া সম্পর্কিত ব্যাপারে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে ভবিষ্যত কর্মপন্থা নিয়ে জোয়নরা নিজেদের মধ্যে পরিকল্পনা করে। এরই অংশ হিসাবে বিভিন্ন তারিখে নিজ এলাকায় তারা বেশ কয়েকটি বৈঠক করে।
চ) ১৬ ফেব্র“য়ারী ২০০৯ সদর রাইফেল ব্যাটালিয়নের বাস্কেটবল মাঠে। এ বৈঠকে জনৈক নেতৃস্থানীয় বিডিআর সদস্য মন্তব্য করে যে, “এরকম দাবী করে কোন লাভ নেই, অফিসারদের জিম্মি করে দাবী আদায় করতে হবে”।
ছ) ১৮ ফেব্র“য়ারী ২০০৯, সন্ধ্যা ৭.৩০ ঘটিকায় ৫ নং গেইট সংলগ্ন বেসামরিক জাকিরের প্রাইম কোচিং সেন্টারে প্রায় ১ ঘন্টা বৈঠক করে। জানা যায়, তাদের দাবী দাওয়া সম্বলিত একটি খসড়া লিফলেট প্রাইম কোচিং সেন্টারে টাইপ করিয়ে ২১ ফেব্র“য়ারী পিলখানার সকল ব্যাটালিয়নসহ আরএসইউ অফিসারদের কাছে বিতরণ করে।
জ) ডিএডি তৌহিদ, ডিএডি রহিমসহ আরো ৩/৪ জন ডিএডি ৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়নের এক সৈনিকের বাসায় বৈঠক করে।
ঘ) ঘটনার পূর্ব রাত্রে ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের মাঠে একটি চূড়ান্ত বৈঠক হয়।কিন্তু লোকসংখ্যা বেশী হওয়ায় পরে চক্রান্তকারীরা ৫নং গেইটের বাইরে ল্যা: না: জাকারিয়া (সিগন্যাল) এর ভাড়া নেয়া টিনসেড বাসায় ৯.৩০ পর্যন্ত এ বৈঠক চলে।
এ রাতে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়ঃ
(ক) ডিজি ও ডিডিজিকে জিম্মি করা হবে এবং তাদের মাধ্যমে
অন্যান্য অফিসারদেরও জিম্মি করা হবে;
১০
(খ) ডিজিকে মনোনীত ২ জন বিডিআর জোয়ান অস্ত্র ধরবে;
(গ) ডিজি’র মাধ্যমে অন্য অফিসারদের জিম্মি করা হবে। কোন বাধা আসলে গুলি করা হবে, তবে হত্যা করা হবে না;
(ঘ) কোত (শড়ঃব) ও ম্যাগাজিন একসাথে দখল করতঃ হামলার পরিকল্পনা করা হয়;
(ঙ) জিম্মি করার পর সরকারের কাছে দাবী আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়;
এবং
(চ) মিটিং শেষে ২০-২৫ জন বিডিআর সদস্য দাবী আদায়ে হাতে হাত রেখে শপথ নেয়।
৩) তবে কমিটি মনে করে এজন্য বিপুল সংখ্যক সেনা
কর্মকর্তাকে নৃশংসভাবে হত্যার বিষয়টি তাদের ক্ষোভের সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল না। সার্বিকভাবে দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করার জন্য কোন মহল বিডিআর বিদ্রোহীদের দাবী-দাওয়ার আড়ালে নিজেদের কায়েমী স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়াস পেয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়
৪) এসএমজি হাতে উক্ত সৈনিক মহাপরিচালকের দিকে এগিয়ে আসার পরক্ষণেই একটি ফাঁকা গুলির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়, যা ছিল সকল বিডিআর বিদ্রোহীদের উদ্দেশ্যে দরবার হল ত্যাগ করার একটি সংকেত বিশেষ। এই সময় কতিপয় বিদ্রোহী দরবার হলে উচ্চ স্বরে ‘জাগো’ বলে চিৎকার করে
৫) আনুমানিক ৯.৩০ ঘটিকায় মহাপরিচালক বিডিআর স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধান,মহাপরিচালক র‌্যাব এবং মহাপরিচালক ডিজিএফআই এর সাথে মোবাইল ফোনে কথা বলেন এবং জানান যে, ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে।
তিনি অনতিবিলম্বে সেনা হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান। এছাড়াও অবরুদ্ধ অন্যান্য সেনা কর্মকর্তাগণও তাদের মোবাইলে সাহায্যের জন্য বিভিন্ন স্থানে টেলিফোন করেন ও এসএমএস পাঠান। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের তাঁদের অসহায়ত্বের খবর জানান সাহায্যের প্রত্যাশায় আটকে পড়া কর্মকর্তারা জানায়- “দরবার হল বিদ্রোহী বিডিআর জোয়ানদের নিয়ন্ত্রণে। আমরা বন্দি। আর কথা বলা যাচ্ছে না, দ্রুত ব্যবস্থা নিন। … আর
হয়তো দেখা হবে না। তুমি ভাল থেকো, আমার সন্তানদের যত্ন নিও। ইত্যাদি। ইত্যাদি।”
৬) দুপুর ১২.৩০ মিনিট নাগাদ ৩ নম্বর গেইটের সামনে বিডিআরের পক্ষে শতাধিক মানুষের মিছিল হয়। এরা বিডিআর জোয়ানদের দাবী-দাওয়ার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে “জয় বাংলা জয় বিডিআর”, “বিডিআর-জনতা ভাই ভাই” ইত্যাদি স্লোগান দিতে শোনা যায়।
৭) পরে তারা ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধি দলকে নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার জন্য ‘যমুনায়’ রওনা হন। কিন্তু এ ১৪ জনের কোন নামের তালিকা এ তদন্ত কমিশন কর্তৃক পাওয়া যায় নি।
৮) উল্লেখ্য , উক্ত বিবৃতিতে বিডিআর এর মহাপরিচালক বা অন্যান্য অফিসারদের পরিনতি বা তাদের ছাড়ার ব্যাপারে কোন বক্তব্য দেয়া হয় নি। তবে এব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী জনাব নানক বলেন যে, ভেতরে মহাপরিচালক ও অন্যান্য অফিসারদের ব্যাপারে আলাপ হয়েছে। তখন বিদ্রোহী প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীকে তারা ভালো আছেন বলে জানিয়েছে। তিনি বিদ্রোহীদের দাবী-দাওয়া পর্যায়ক্রমে পূরণ করা হবে বলে আশ্বাস প্রদান করেন। বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যদের পক্ষে ডিএডি তৌহিদ অনুরূপ বক্তব্য দেন। তিনি সকল বিডিআর সদস্যকে অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাবার আহবান জানিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ হতে সাধারণ ক্ষমা, অস্ত্র জমা দেয়া এবং আটককৃত শিশু ও মহিলাদের মুক্তি দেওয়ার শর্ত ছাড়া আর কোন শর্ত আরোপ করা হয়েছিল কিনা তা জানা যায় নি।
৯) এ সময় বিদ্রোহীরা তাদের অপকর্মের সুবিধার্থে
পিলখানার অভ্যন্তরে বিশেষ বিশেষ স্থানে বিদ্যুৎ নিভিয়ে দেয়। কিন্তু পিলখানা এলাকায় কেন বিকল্প ব্যবস্থায় আলোকিত করার কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কমিটি তার সদ্যুত্তর পায় নি।
১০) সন্ধ্যার পর পিলখানায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্য ছিল
বাইরের আক্রমন ঠেকানো এবং এ সুযোগে তাদের অপকর্ম ঢাকা দেয়া।
১১) ইতিমধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলে নুর তাপসের নির্দেশে পিলখানার পাশ্ববর্তী ৩ কিলোমিটার এলাকা এলাকাবাসীকে খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় মাইকিং করে । এছাড়া সেনাবাহিনীকে ও ছেড়ে দেওয়ার জন্য মাইকিং নির্দেশ দেওয়া হয়।
১২) এটি একটি অত্যন্ত পরিকল্পিত ঘটনা ছিল। যদি তাই হয়, প্রশ্ন উঠেছে, দেশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থাগলো কি এ বিষয়ে সরকারকে কোন আগাম সতর্ক বার্তা দিয়েছিল? যদি দিয়ে থাকে, তবে তা প্রতিহত করার জন্য কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল? যদি না দিয়ে থাকে, তবে কেন দিতে পারেনি? এর দায়-দায়িত্বই বা কার ছিল?
১৩) জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা মহাপরিচালকের দপ্তর থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পিলখানা সফর উপলক্ষে একটি প্রতিবেদন (সংযোজনী-১৩) ২৩
ফেব্র“য়ারী ২০০৯ তারিখে এসএসএফ-এর নিকট পাঠানো হয়। এ প্রতিবেদনে
বলা হয় যে, ”বর্ণিত কর্মসূচীতে যোগদানের ক্ষেত্রে ভিআইপি.র ব্যক্তি
নিরাপত্তায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হুমকি সংক্রান্ত কোন তথ্য আপাততঃ নেই।”
প্রতিবেদনে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলা হয়, ”… ভিআইপি কর্তৃক
অনুষ্ঠানস্থলে অবস্থান ও গমনাগমন পথে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনের
নাশকতামূলক তৎপরতার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না বিধায় ভিআইপি’র
নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা সমীচীন।” এছাড়াও
এনএসআই ভিভিআইপি’র সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কিছু রুটিন
সুপারিশ করেছে। বিদ্রোহে চলাকালে এবং বিদ্রোহ পরবর্তীতেও এ সংস্থার
তেমন কোন তৎপরতা পরিলক্ষিত হয় নি।
১৪) সংশি−ষ্ট পুলিশ, র‌্যাব ও সেনা বাহিনীর সংশি−ষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে (সংযোজনী-১৮,১৯,২০) আলোচনা করে জানা যায় যে, পিলখানায় বিদ্রোহের খবর যথাক্রমে সকাল ৯.৫০, ৯.৩০ এবং ৯.৩০মিনিট নাগাদ টেলিফোনে পৌঁছায়। এদের কারো কাছেই পিলখানা বিদ্রোহ সম্পর্কে কোন আগাম তথ্য ছিল না। এতদসত্ত্বেও দেখা যায় যে, সকাল ৯.৫০ টায় র‌্যাবের প্রথম দল ও ১১.০০ টায় সেনাবাহিনীর প্রথম দলটি বিডিআর পিলখানা এলাকায় পৌঁছে যায়। পুলিশ উপস্থিতির সঠিক সময় ও সংখ্যা জানা যায় নি।
১৫)এতে দেখা যায়, পিলখানার ভৌগোলিক অবস্থান (ঘনবসতি, ট্যানারী, ইত্যাদি) পুলিশ, র‌্যাব এর পক্ষে উপযুক্ত কোন অভিযান পরিচালনা সম্ভবপর ছিল না অজুহাতে কর্ডন করা হয় নি, যা যুক্তিযুক্ত নয়। ফলশ্র“তিতে বিদ্রোহীরা দেয়াল টপকে সহজে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। প্রত্যক্ষদর্শীর মতে অনেক বিডিআর সদস্য ও তাদের পরিবার-পরিজন ১ ও ৫ ন¤ ^র গেইট দিয়ে তাদের শুভানূধ্যায়ীদের সহযোগিতায় সহজেই বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। উপরন্তু, সন্ধ্যায় হঠাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে বিদ্রোহীদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করা হয়।
১৬) পিলখানায় বিদ্রোহ দমন ও উদ্ধার অভিযান
বিদ্রোহের সূচনার পরবর্তীতে ২৫ ও ২৬ ফেব্র“য়ারী তারিখে পিলখানায় বিদ্রোহ দমন ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন œপদক্ষেপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বিদ্রোহী দমনে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি এবং উদ্ভুত সংকট নিরসনে রাজনৈতিক আলোচনার যুগপৎভাবে চলতে থাকে। এধরনের উদ্ধার অভিযানের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে একমাত্র উপযুক্ত আর্মি কমান্ডো ব্যাটালিয়ন যা সিলেটে অবস্থিত বিধায় তা দ্রুত বিদ্রোহের সূচনালগ্নে নিয়োজিত করা সম্ভব হয় নি। এতদসত্ত্বেও দেখা যায় যে, বেলা ১২- ১২.৩০ টার মধ্যে মোটামুটিভাবে সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের
৩৩
উলে−খযোগ্য সংখ্যক সদস্য পিলখানা এলাকায় অবস্থান নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা অধিকতর গুরুত্ব পাওয়ায় এবং বিদ্রোহীর দাবীর মুখে এসব বাহিনীকে বরং নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানের আদেশ দেওয়া হয়।
১৭) বিডিআর বিদ্রোহীদের নির্বিঘ্নে পিলখানা হতে পলায়ন
কিছু বিডিআর সদস্য ও সেনা কর্মকর্তা প্রথম প্রহরে দরবার হলের নারকীয়তা থেকে পালিয়ে পিলখানা ত্যাগ করতে সক্ষম হয়। তবে পিলখানার গেইটের অদূরে পুলিশ ও র‌্যাব অবস্থান নিলেও চারদিকের দেয়াল ছিল অরক্ষিত এবং কোন কর্ডনের ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে বিদ্রোহীরা নির্বিঘেœদেয়াল টপকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তবে সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ সরবরাহ উদ্দেশ্যমূলকভাবে বন্ধ করায় এ পালানোর কাজ সম্ভবতঃ ২৫ তারিখের রাতে বেশি হয়েছিল। রাতে পালাতে গিয়ে লুটের মালামাল সাথে নিতে বিদ্রোহীদের কোন অসুবিধা হয়নি।
১৮) ২৫ ফেব্র“য়ারী তারিখে পিলখানা বিদ্রোহের কারণে সকল সেনা কর্মকর্তাদের পরিবার-পরিজন আটকে পড়েছিল। কিন্তু পিলখানায় জেসিও ও শত শত সৈনিক পরিবার-পরিজন নিয়ে কোর্য়াটারে বসবাস করতো।
২৬ তারিখে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পনের পর এ সব পরিবারকে পিলখানা থেকে বের হয়ে আসতে দেখা যায় নি। এতে প্রতীয়মান হয় যে, ইতোমধ্যে তাদের নিরাপদে পিলখানা ত্যাগের সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল।
১৯) বিদ্রোহীরা বিদ্রোহ চলাকালে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারের জন্য একাধিক চিরকুট সাংবাদিকদের মাঝে হস্তান্তর করে। এসমস্ত চিরকুটে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাস্তবতা বিবর্জিত অনেক অপপ্রচার ও কুৎসা ছিল, যা মিডিয়াসমূহ তাৎক্ষনিকভাবে অবিবেচকের মতো প্রচার করে। এর প্রভাবে দেশ, জাতি ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সেনাবাহিনীর মতো একটি গৌরবোজ্জ্বল প্রতিষ্ঠানের সুনাম বিনষ্ট হয় এবং একইসাথে জনমনে বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করা হয়।
২০) প্রশ্ন উঠেছে, মিডিয়ার এ সকল কর্মকান্ড কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল? মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারণা জনগনকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছিল, এবং
তাতে বিদ্রোহীরা সফলতাও পেয়েছিল। আবার অনেক ক্ষেত্রে মিডিয়া কোন কোন নেতিবাচক বিষয় এমনভাবে উপস্থাপন করেছে (বিশেষ করে টকশো’তে), যা সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতার জন্ম দিয়েছে।
আরো জানতে ….
উইকিলিকসের তথ্য: সেনা তদন্ত দলের প্রস্তাব নাকচ করেন শেখ হাসিনা : ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের পর গঠিত সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়েছিল। এতে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হন এবং তাদের ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ওই বছরই ২৭শে এপ্রিল ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির সঙ্গে এক সাক্ষাতের সময় তার কাছে এ তথ্য প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। গত ৩০শে আগস্ট উইকিলিকস যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কূটনৈতিক গোপন তারবার্তা প্রকাশ করেছে তাতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে বিদ্রোহীরা নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেখানে হত্যা করা হয় ৫৭ সেনা অফিসার ও ১৭ জন বেসামরিক ব্যক্তিকে। এরপর ২রা মার্চ সেনাবাহিনী ২০ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এর প্রধান করা হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে। ওই ঘটনা তদন্তে সরকারও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেনাবাহিনীর কমিটি তদন্ত করে আলাদাভাবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মরিয়ার্টির ওই বৈঠককে উদ্ধৃত করে ওই তারবার্তায় উল্লেখ করা হয়, সেনাবাহিনীর আলাদা তদন্তের ব্যাপারে শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। প্রাথমিকভাবে এ কমিটিকে সামরিক বিষয়-আশয়- যেমন বিদ্রোহের সময় খোয়া যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের হিসাব বের করার মতো বিষয় তদন্তের জন্য সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, কিভাবে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে চেয়ে সামরিক তদন্তকারীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়? এ জিজ্ঞাসাবাদের কাজ পুলিশের- এ কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি ওই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ওই একই বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে শেখ হাসিনা বলেন, বিডিআর বিদ্রোহে তার দল থেকে সরকারে যেসব কর্মকর্তা রয়েছেন তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ করতে আটক বিডিআর সদস্যদের স্বীকারোক্তি দিতে চাপ দিচ্ছে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকে শেখ হাসিনা ও জেমস এফ মরিয়ার্টি বেসামরিক-সামরিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি যোগ দিয়েছিলেন হাওয়াইয়ে অনুষ্ঠিত প্যাসিফিক এরিয়া স্পেশাল অপারেশন্স কনফারেন্সে। এ নিয়ে একটি নোট শেখ হাসিনাকে পড়ে শোনান মার্কিন রাষ্ট্রদূত। মরিয়ার্টি বলেন, তারা এশিয়া-প্যাসিফিক স্টোর ফর সিকিউরিটি স্টাডিজ সফর করেছেন। এ সংস্থা চায় বাংলাদেশে সরকার, সামরিক ও রাজনৈতিক নেতাদের জন্য সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক নিয়ে একটি ওয়ার্কশপ আয়োজন করতে। এ প্রস্তাবে সমর্থন দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মন্ত্রিসভা বারণ করেছিল
২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের পর পরই ১লা মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে বিক্ষুব্ধ সেনা কর্মকর্তাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে সহকর্মী হারানোর শোকে বিহ্বল বিভিন্ন পদবির প্রায় ৫০০ বিক্ষুব্ধ সেনা কর্মকর্তার মুখোমুখি হন তিনি। মন্ত্রিসভার সদস্যরা এ বৈঠকের আগে বিপদের আশঙ্কা করে প্রধানমন্ত্রীকে সেনানিবাসে যেতে নিষেধ করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, উত্তপ্ত সে বৈঠক শেষ করে ঢাকা সেনানিবাস থেকে হাসিনা নিরাপদে ফিরে আসায় কেউ কেউ বিস্ময়ও প্রকাশ করেছিলেন। ২০০৯ সালের ১লা মার্চ এ গোপন তারবার্তা ওয়াশিংটনে পাঠান ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি। এর নম্বর ঢাকা-০০০২১৩। এর বিষয়ে ‘প্রাইম মিনিস্টার মিটস আর্মি অফিসারস ইনবিড টু কুয়েল অ্যাঙ্গার ওভার হ্যান্ডলিং অব মিউটিনি’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর বরাত দিয়ে তিনি এ বার্তাটি পাঠান। গত ৩০শে আগস্ট এ তারবার্তা প্রকাশ করে উইকিলিকস। এতে আরও বলা হয়- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিডিআর বিদ্রোহের অব্যবহিত পরেই ২০০৯ সালের ১লা মার্চ ঢাকা সেনানিবাসে গিয়ে বিক্ষুব্ধ সেনা কর্মকর্তাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ও নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমদ সিদ্দিকী। প্রায় আড়াই ঘণ্টার ওই বৈঠকে শেখ হাসিনা প্রায় ৫০০ বিক্ষুব্ধ সেনা কর্মকর্তার মুখোমুখি হন। মরিয়ার্টি তার তারবার্তায় উল্লেখ করেন, শেখ হাসিনা এ বৈঠকে সেনা কর্মকর্তাদের তীব্র ক্ষোভের মুখোমুখি হন। উত্তেজিত কিছু সেনা কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীকে নানা ধরনের কটূক্তিও করেছিলেন। তারিক আহেমদ সিদ্দিকী ওই বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগ বিরোধী কিছু কট্টরপন্থি সেনা কর্মকর্তাকে চিনতে পেরেছিলেন। এদের মধ্যে অনেকেই চিৎকার করে নিজেদের বক্তব্য দেয়ার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন। তবে তারিক আহেমদ সিদ্দিকী জানান, বৈঠকের পুরো সময়ই ব্যাপক উত্তেজনা থাকলেও এটি শেষ হয় শান্তিপূর্ণভাবে, মোনাজাতের মাধ্যমে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করা হয়। তারিক আহেমদ সিদ্দিকী জানান, সেদিন শেখ হাসিনা অক্ষত থাকায় তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। মরিয়ার্টির পাঠানো তারবার্তা অনুযায়ী, সেনানিবাসের সে বৈঠকে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার ছিল না। তবে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে মরিয়ার্টি জানতে পেরেছেন, বৈঠকে সংক্ষুব্ধ সেনা কর্মকর্তারা এ ঘটনায় মধ্যস্থতাকারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের পদত্যাগ দাবি করেন। কিছু কর্মকর্তা বৈঠকে বিক্ষোভ প্রদর্শনও নাকি করেছিলেন। তারা বেশ কিছু চেয়ার ভাঙচুর করেছিলেন বলে জানা যায়। সেনা কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ওই হত্যা ও অত্যাচারের সঙ্গে জড়িত বিডিআর সদস্যদের দ্রুত বিচারের দাবি করেন। কয়েক জন দাবি জানান, দোষীদের প্রকাশ্যে ফাঁসি দিতে হবে। রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি তার তারবার্তার এক পর্যায়ে উল্লেখ করেছেন, বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় অনেক সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তা বিশ্বাস করেন, প্রধানমন্ত্রী বিডিআর বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেনা অভিযানের নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। এছাড়া বিডিআর জওয়ানদের বেতন-ভাতা নিয়ে অসন্তোষ ও বিডিআরে প্রেষণে নিয়োগ পাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখার কথাও তার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। বিডিআর বিদ্রোহ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বেশির ভাগ হত্যার ঘটনা ঘটেছিল বলে মরিয়ার্টি তারবার্তায় উল্লেখ করেছেন।

You may also like...

Read previous post:
The Doel Laptop Fiasco and Joy:

When it came to importing the machinery to manufacture government sponsored laptops ‘Doel’, we came across a scale of corruption...

Close