৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের কারনামাঃ

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে গোলামের কারনামাঃ

ধর্মীয় গোঁড়ামি আর মৌলবাদের আঁকড়া জামায়েত ইসলামীর আমীর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম বরাবরই পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতো। এই নরঘাতক কোনভাবেই চায় নি বাংলাদেশ স্বাধীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক। এই জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় গোলাম আযম এর রাজনৈতিক অবস্থান ছিল পাকিস্তানের পক্ষে এবং মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামীলীগ কে ষড়যন্ত্রকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে। মুজিবনগর গঠনের পর ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ডাক দেন, তার পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু জামায়েতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে ২৫ মার্চ এর পর থেকে এই রাজাকার গোলামের বিভিন্ন ধরনের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মন্তব্য  নিয়মিত প্রকাশ পেতে শুরু করে। ২৫ মার্চ সেই ভয়াল রাতের নিরাপরাধ মানুষদের হত্যাযজ্ঞ শেষ হবার ঠিক ৬ দিন পর রাজাকার গোলাম ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে একটা ভাষণ দেয়। ভাষণে মৌলবাদী আগ্রাসন থেকে সুরু করে ভারতের কড়া সমালোচনা করে বলে,

‘‘ভারত সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ করে কার্যত পূর্ব পাকিস্তানীদের দেশপ্রেমকে চ্যালেঞ্জ করছে। আমি বিশ্বাস করি যে, আমি বিশ্বাস করি যে, এই অনুপ্রবেশকারীরা পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানদের নিকট হতে কোন প্রকার সাহায্য পাবে না।’’

২০ জুন, ১৯৭১ সালে গোলামের এক বক্তব্য পাকিস্তানের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন পুনুরাব্যাক্ত করে বলে, “পাকিস্তনি বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় সকল সন্ত্রাসীদের হটিয়ে দিয়েছে।”

মুক্তিযুদ্ধকে গুলাম আযম ভারতের ষড়যন্ত্র বলে মনে করতো। তাই ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল শান্তি বাহিনী গঠন করা হয়। ১২ এপ্রিল গোলাম আযম এবং আর এক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ওরফে মইত্যা রাজাকার মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যাইত করে একটি বিক্ষোভের ডাক দিয়ে এর নেতৃত্ব দেয়। শান্তি বাহিনী মুলত মুক্তিযুদ্ধে বর্বরতম রাজাকার বাহিনী ছিল এবং গোলাম আযম এই বাহিনীর অন্যতম একজন প্রতিষ্ঠাতা। গোলাম আজমের জামায়েত ইসলামী, মুসলিম লীগ ও বিহারীদের কে নিয়ে গঠিত হয় শান্তিকমিটি। এবং এই রাজাকারদের গুষ্ঠি শান্তি কমিটি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের প্রত্যক্ষ ভাবে সকল মানবতাবিরধী অপরাধ সংঘটনে অংশ নিত এবং সাহায্য করতো। এই রাজাকার গোষ্ঠী তাদের  মূল কর্মকাণ্ডের লিস্ট এর মধ্যে স্থানীয় হিন্দু পরিবারদের যত সম্পদ, জমি, ভিটা-মাটি দখল করে সেগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিত। মুক্তিবাহিনী, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের,আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের বাড়িতে রাস্তায় হানা দিত, তাদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের কথা জানার জন্য নানা ভাবে অত্যাচার এবং হয়রানি করতো। মেয়েদের কে ধরে নিয়ে যেত। এবং গ্রামে গ্রামে গিয়ে এরা রাজাকার সদস্য সংগ্রহ করতো। রাজাকার বাহিনীর জন্য গোলাম আযম তার জামায়েত ইসলামী দল থেকে ৯৫ জন সদস্যকে বাছাই করে প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করে। যাদেরকে খুলনায় শাহজাহান আলী সড়কের আনসার ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। দেয়া হয়েছিল অস্ত্র। জবাই করে মানুষ মারতে হবে কি করে তাও শেখানো হয়েছিল। গুলি যাতে কম খরচ হয় তাই জবাই করে মানুষ খুন করার বিভিন্ন নিয়ম শেখানো হতো ওই ক্যাম্পে। এছাড়া গোলামের নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়েতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান আশরাফ হোসাইন জামালপুর জেলায় আলবদর বাহিনী গঠন করে।

যুদ্ধকালীন সময়ে গোলাম প্রায় গোপন বৈঠকের জন্য পাকিস্তানে চলে যেত। সেখানে গিয়ে যুদ্ধের সকল খবর এবং রাজাকার বাহিনী দ্বারা পরিচালিত সকল নৃশংস হত্যা কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করতো। পাকিস্তানি নেতাদের নিয়ে যুদ্ধ সম্পর্কিত আলোচনা করতো। ১৯৭১ এর ৩০ এ জুন পাকিস্তানের লাহোরে সাংবাদিকদের কাছে গোলাম আযম বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ও স্বাধীনতাকামী মানুষদের দেশদ্রোহী এবং দুষ্কৃতিকারী বলে উল্লেখ করে, এবং এদেরকে সমূলে নির্মূল করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এদের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। আমরা যুদ্ধ করছি। এই যুদ্ধে দুষ্কৃতিকারীদের হাতে আমাদের জামায়েত ইসলামের বহু নেতা শহীদ হয়েছেন। ( সুত্রঃ  “লাহোরে সাংবাদিক সম্মেলনে অধ্যাপক গোলাম আযম (Prof. Ghulam Azam in a conference at Lahore)”। Daily Sangram। জুন ২১, ১৯৭১)। গোলাম আযম অয়াকিস্তান সেনাবাহিনী জেনারেল টিক্কা খান এবং অন্য অফিসারদের সাথে বৈঠক করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে কিভাবে বানচাল করা যায় তার গভীর ষড়যন্ত্র করেছিল। বাংলাদেশ থেকে এদের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহনের জন্য বিশদ ভাবে আলোচনা করে। (সুত্রঃHistory speaks up – Julfikar Ali Manik and Emran Hossain”। The Daily Star। অক্টোবর ২৭, ২০০৭।)

রাজাকার গোলাম আযম ৭১ এর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল। এই জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয়। জানা যায় সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে রাও ফরমান আলীর সাথে এক গোপন বৈঠক করে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীল নকশা তৈরি করে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হবার সম্ভাবনা যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছিল এই গোপন বৈঠকের পরিকল্পনায় ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অসংখ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল।

১৯৭১ সালের ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংগ্রামে গোলাম আযমের পশ্চিম পাকিস্তান সফরকালের একটি সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ দুই কিস্তিতে ছাপা হয়। এই সাক্ষাৎকারে রাজাকার গোলাম মুক্তিবাহিনীর সাথে তার দলের সদস্যদের সংঘর্ষের বিভিন্ন বিবরণ ও পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থতির ওপর মন্তব্য করে বলে,

“বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জামায়াতকে মনে করতো পহেলা নম্বরের দুশমন। তারা তালিকা তৈরি করেছে এবং জামায়াতের লোকদের বেছে বেছে হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর লুট করছে জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। এতদসত্বেও জামায়াত কর্মীরা রাজাকারে ভর্তি হয়ে দেশের প্রতিরক্ষায় বাধ্য। কেননা তারা জানে ‘বাংলাদেশ’ ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কোন স্থান হতে পারে না। জামায়াত কর্মীরা শহীদ হতে পারে কিন্তু পরিবর্তিত হতে পারে না।” (দৈনিক সংগ্রাম, ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)

You may also like...

Read previous post:
ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের প্রতিবাদে রাজধানীতে শিবিরের বিক্ষোভ

ছাত্রলীগের অব্যাহত সন্ত্রাস,খুন,ধর্ষণ এবং আইন হাতে তুলে নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ইসলামী ছাত্রশিবির ঢাকা মহানগরী পশ্চিম শাখার উদ্যোগে...

Close