সকল সমাজেই ধর্মানুভুতির সংক্রান্ত সামাজিক ট্যাবু অথবা ক্ষেত্রে বিশেষে আইনি বন্দবস্ত থাকে। প্রায়ই আমরা দেখতে পাই কোন একজন মানুষকে মুরতাদ অথবা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হচ্ছে। কারও কারো মাথার দাম ঘোষণা করা হয়। যদিও মাথার দাম ঘোষণা করার প্রক্রিয়াটি আমার কাছে সেলফ হিপোক্র্যাসি মনে হয়। ধরা যাক সালমান রুশদীর মাথার দাম ঘোষণা করা হয়েছে(ইরান সত্যিই সালমান রুশদীর মাথার দাম ঘোষণা করেছিল, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে আয়াতুল্লাহ খোমেনী করেছিলেন। যতদূর জানি সেই ঘোষণা এখনো উহ্য করা হয় নি।)। এখন মাথার দাম ঘোষণা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে কেউ টাকার লোভে কাজটি করুক। অর্থাৎ কেউ যদি যার মাথা ঘোষণা করা হয়েছে তার উপর কোন ক্ষোভ না রেখেও মাথাটি কেটে নিয়ে আসে তাকেই পুরস্কৃত করা হবে। অর্থাৎ কেউ ধর্মবোধ থেকে উদ্বুদ্ধ হবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার শত্রু কে নাশ করা তথা আত্নোপলব্ধির চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কার্য সিদ্ধি। এই প্রক্রিয়াটি সত্যিকার অর্থে ধর্মীয় ন্যায়শাস্ত্র পুরো রূপটা উন্মোচিত করে দেয়। ঠিক বেঠিক আসলে আলোচনার চেয়ে নির্দিষ্ট অথোরিটির সিদ্ধান্ত মেনে চলার প্রক্রিয়া।
আমার কৌতূহল আসলে জানা ধর্মানুভুতি জিনিসটা কি? কাকে আমরা ধর্মানুভুতি বলব? সঠিক ভাবে যদি ধর্মানুভুতির সংজ্ঞায়ন না করা যায় তাহলে সেটা মেনে চলার ব্যবহারিক অসুবিধা আছে। কয়েকবছর আগে প্রথম আলোর ফান ম্যাগাজিন আলপিনে একটা কৌতুক নিয়ে প্রচণ্ড হইচই হয়। আমি নিশ্চিত কার্টুনিস্ট স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে নি যে এই কার্টুনটিকে এভাবে ইন্টারপ্রেট করা হবে। আপাতত ব্লাসফেমী বা এ সংক্রান্ত প্রচলিত আইন , অথবা এ সংক্রান্ত সামাজিক ধারনা খুবই ধোয়াশাপুর্ণ। ঠিক কি কি বিষয়কে ধর্মানুভুতির এক্তিয়ারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে সেটা সুনির্দিষ্ট নয়।
সকল ধর্মই কিছু নির্দিষ্ট নীতির উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই সকল নীতি কে সাধারণত স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে মেনে নেয়া হয়। তাদের কোনটির সমালোচনা করা হলে সাধারণত বিক্ষোভের সুর শোনা যায়। সমস্যা হচ্ছে সকল ধর্মই একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক। মুসলিমরা বলে এক আল্লাহ, হিন্দুরা বলে অনেক আল্লাহ, খ্রীস্টানরা বলে জেসাস ঈশ্বরের পুত্র ছিলেন ইত্যাদি। অনেক মাইনর ধর্ম আছে যেগুলোর না না রকম বিশ্বাস আছে। এমন ধর্মও আছে যারা সূর্য কে দেবতা মনে করে। আফ্রিকান মাসাই উপজাতিতে সিংহ কে অনেক পবিত্র মনে করা হয়। হিন্দু ধর্মতে গরুকে। এখন পৃথিবীতে ধর্মের সংখ্যা অসংখ্য। সকলের নীতি এবং পবিত্র জিনিসের তালিকা করা হলে সেই তালিকার আকৃতি যথেষ্ট ভীতিকর হবে। ধরা যাক সেই তালিকা সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হবে। জাতিসংঘের ইউনেস্কো এই তালিকা সংকলনের দায়িত্ব নেবে। তারপর বিভিন্ন সরকারী অফিস, স্কুলে এই তালিকা সরবরাহ করা হবে। যারা ধর্মের প্রতি আক্রমণে দুঃখ পান তাদের আর দুঃখ পেতে হবে না। সকল ধর্মের পবিত্র ব্যাপার গুলো তালিকাবদ্ধ হলে সেই তালিকার কোন বিষয়ের ব্যাপারে কেউ আক্রমণাত্মক হওয়া যাবে না। যৌক্তিক হলেও আলোচনা করা যাবে না। কোন পবিত্র বিষয় হলে তার সম্পর্কে ঋণাত্মক কথা বলা যাবে না। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক একটি ধর্মের পবিত্র বিষয়ের তালিকায় আছে গবাদি পশুর বিষ্ঠা। এখন কেউ বলতে পারবে না গবাদি পশুর বিষ্ঠা নোংরা। কারণ এটির মাধ্যমে একটি পবিত্র বিষয়কে আক্রমণ করা হয়েছে। এখন কেউ কেউ বলবেন গবাদি পশুর বিষ্ঠাকে পবিত্র ভাবলে সেটা অযৌক্তিক। তখন তাকে বলা হবে তার বিশ্বাসের অনেক বিষয় ও অযৌক্তিক । যুক্তির বিচারে পবিত্রতার তালিকা করা যায় না। পবিত্রতার তালিকা হচ্ছে বিশ্বাস-ভিত্তিক। এই প্রক্রিয়া সকলকে খুশি করবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। কারণ এইরকম তালিকা তৈরি হলে অচিরেই দেখা যাবে কথা বলার কোন বিষয় পাওয়া যাবে না। আপনি ডানে বামে যেদিকেই যাবেন পবিত্র কোন না কোন জিনিসের সাথে ধাক্কা খাবেন এবং আইন অনুযায়ী আপনি শাস্তির যোগ্য হবেন।
অবশ্য আসল জটিলতা তৈরি হবে অন্য-খানে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই একটি ধর্মের পবিত্র কিছু অন্য ধর্মের অপবিত্র কিছুর সাথে মিলে যেতে পারে। তখন কি হবে? কারণ যার কাছে অপবিত্র তার ধর্ম পালনের অধিকার আছে। আবার যার কাছে পবিত্র তার ব্লাসফেমী আইনের অধীনে ধর্মকে আক্রমণের হাত থেকে বাঁচানোর অধিকার আছে। সুতরাং ব্যবস্থাটা পরিণত হবে প্যারাডক্সে। আমি নিশ্চিত এমন কোন ব্লাসফেমী আইন তৈরি করা সম্ভব না যার মাধ্যমে সকল ধর্মানুভুতির সুরক্ষা সম্ভব। এর একটি সমাধান হচ্ছে সকল ধর্ম বাদ দিয়ে কিছু ধর্ম বেছে নেয়া যারা ঐ জিওগ্রাফিক লোকেশনের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। এটারও সমস্যা আছে। উদাহরণ স্বরূপ বাংলাদেশের জন্যে ইসলাম/খ্রিস্টান/হিন্দু/বৌদ্ধ ধর্ম বেছে নেই। এখানে সমস্যা হচ্ছে এই প্রধান ধর্ম গুলিও সাংঘর্ষিক। ইসলাম ধর্মে মূর্তি পূজার কোন স্থান এবং এটি একটা প্রধানতম ধর্মীয় অপরাধ। অন্যদিকে হিন্দু ধর্মে পৌত্তলিকতা রয়েছে ইত্যাদি। এখন যখন একজন হিন্দু মূর্তিপূজা করে তখন এটি ইসলামের দৃষ্টিতে খারাপ কাজ করে। এটি মেনে নেয়া হয় যে সকলের ধর্ম পালনের অধিকার আছে এই ভিত্তিতে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ধর্মীয় সম্প্রদায় গুলি সত্যিকার অর্থে ব্লাসফেমী আইন মানে না। তারা ততক্ষণ চুপ থাকে যতক্ষণ তাদের মতে খারাপ কাজ গুলি করছে অন্য কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়। অর্থাৎ যদি আমি কোন ধর্মীয় সম্প্রদায় এর অন্তর্ভুক্ত হই আমার কোন সমস্যা হবে না। কেউ কিছু বলবে না। সমস্যাটা সত্যিকার অর্থে হয় যদি প্রতিপক্ষ কোন ধর্মের সদস্য না হয়। অর্থাৎ ব্লাসফেমী আইন আসলে নির্দেশ করে যে কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত না হলে তাকে নির্দিষ্ট কিছু অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে। সেই অধিকারগুলো হচ্ছে ধর্মকে সমালোচনার অধিকার। ধর্মকে সমালোচনার অধিকার কাউকে না দেয়াটা তাই একধরনের বৈষম্য। আধুনিক রাষ্ট্র কখনই সফল হতে পারবে না যদি এর ভিত্তিতে বৈষম্যমুলক ধারনা থাকে। আধুনিক সমাজও তার বিকাশের দিকে মুখ থুবরে পরবে যদি এরকম বৈষম্যমুলক নর্মের উপর নির্ভর করে থাকে।
ধর্মানুভুতির ধারনা একটি মধ্যযুগীয় বৈষম্যমুলক ধারনা। এটি উৎসাহিত করে নাগরিকের বক্তব্য নিয়ন্ত্রণের জন্যে যখন এর কোন দরকার নেই। কোন ধর্মের সমালোচনা কখনো কোন ধার্মিকের ধর্ম পালনে বাধা দেয় না। তাই সুতরাং বলতে দেবার অধিকার সত্যিকার অর্থে কারও অধিকার হরণ করে না। বলতে দেবার অধিকার কারো কোন ফিজিক্যাল ক্ষতিও করে না। দেশাত্মবোধ এবং ধর্মানুভুতির সুস্পষ্ট পার্থক্য হচ্ছে দেশাত্মবোধ বৈষম্যমুলক নয়, আর জাতির উৎকর্ষের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। সেখানে ধর্মানুভুতির কোন ইহ-জাগতিক লাভ নেই, এটি শুধুমাত্র চিন্তা এবং তা প্রকাশের বাধার মাধ্যমে শৃঙ্খলের বাধা সমাজ উপহার দিতে পারে।
অন্তর্জলে প্রায়ই ধর্ম বিদ্বেষী বলে একটা ট্যাগ দেখা যায়। ধর্ম বিদ্বেষ ঠিক কি জিনিস আমি জানি না। আমার মনে হয় যারা তাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর কথা প্রবল ভাবে প্রকাশ করে তাদেরই বিদ্বেষী বলা হয়। যেমন আমি ধর্মে বিশ্বাসী নই। এবং সেই সাথে মনে করি সকল ধর্ম অসত্য ও ক্ষতিকর। কিন্তু আমার প্রকাশ ভঙ্গি যেহেতু সামাজিক সুশীলতার মোড়কে মোড়া সেহেতু আমি হয়ত কল্লায় কোপ নাও খেতে পারি। কিন্তু যাদের সোশাল স্কিলের ঘাটতি আছে আর যারা আমার চেয়ে কম ভণ্ডামি করতে পারে তারা রেহাই পাবে না। আদতে আমরা পুরস্কার দিচ্ছি সোশাল গড্ডালিকাকে। যে যত ভণ্ড সে তত ভাল এই ভিত্তিতে।
আজ থেকে ভাবছি একটি নিজস্ব ধর্ম তৈরি করব। এই ধর্মের প্রধান কথা হচ্ছে কথা বলার স্বাধীনতা পবিত্র বিষয়। সুতরাং যেই আমার কথা বলার অধিকারের মাঝে সেন্সর বসাতে চান তারা আসলে আমার ধর্মের পবিত্র বিষয়টিকে আক্রমণ করছেন। সুতরাং ধর্মানুভুতির হিসেবে আমি কথা বলার অধিকার ব্লাসফেমী আইনের অধীনেই পাব।