জলের পর ভারতের গরু কূটনীতি দেখছে বাংলাদেশের মানুষ। বছরের পর বছর ঘুরে গেলেও তিস্তা নদীর পানি বন্টন নিয়ে এখনো কোনো চুক্তি করতে ব্যর্থ হয়েছে ভারত। সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিস্তা চুক্তি নিয়ে তিনি কোনো কথা বলবেন না, বিষয়টি বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের ব্যাপার। অথচ কে না জানে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকায় এলেও তার সঙ্গে মমতা বন্দোপাধ্যায় আসেননি বলে তিস্তা চুক্তি হয়নি। এরপর অবশ্য ঢাকায় দু’বার এসেছে মমতা কিন্তু তিস্তা চুক্তি হয়নি। মমতা এখন বলছেন, বাংলাদেশ নিয়ে তার একটা সেন্টিমেন্ট কাজ করে, তিনি বাংলাদেশকে ভালবাসেন।
এদিকে জলের পর ভারত এবার গরু কূটনীতি শুরু করেছে। বাংলাদেশে ভারতীয় গরু যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্যে সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে দেশটির সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ। বাংলাদেশের বিজিপির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেছেন, সীমান্তে হত্যা শুন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতেই বাংলাদেশি নাগরিকদের তিনি ভারতে গরু না আনতে যাওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
আজিজ আহমেদ বলেন,সাম্প্রতিকালে ভারত থেকে গরু আসার সংখ্যা কমে গেছে । বিএসএফ এর সাথে বৈঠক সম্পর্কে বলেন, বিভিন্ন কারণে ভারত সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে চাচ্ছে । অনেকটা কমেছে, আরও কমানোর জন্য বাংলাদেশের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে। তিনি মনে করেন, সীমান্তে যদি গরু ব্যবসা বন্ধ করা যায় তাহলে অনেকাংশে সীমান্তে হত্যা বন্ধ করা সম্ভব হবে।
এতদিন সীমান্ত হাট খুলে বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের মধ্যে সম্পর্কন্নোয়ন ও চোরাচালান রোধে ভূমিকা রাখার কথা বলা হলেও গরুর ব্যাপারে তা টিকছে না। সীমান্ত দিয়েই পদ্মার ইলিশ কোলকাতার বাবুদের পাতে গিয়ে পড়ছে। কখনো কখনো ইলিশ রফতানি বন্ধ হলে চোরাই পথে সে ইলিশ যাচ্ছে ভারতে। এজন্যে অবশ্য কখনো সীমান্তে গুলি করে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটেনি। মাস কয়েক আগে ঢাকা থেকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ছুটে গেলেন ত্রিপুরা সীমান্তে মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের সঙ্গে সীমান্ত হাট উদ্বোধনের জন্যে। বাংলাদেশ থেকে পণ্য যা যাচ্ছে তারচেয়ে অনেক বেশি পণ্য ভারত থেকে আসছে। তো গরু এলে ক্ষতি কোথায়!
গরু হলে ভিন্ন কথা। বিজিবির মহাপরিচালক বলেছেন, গরু আনা নেওয়ার কাজ করতে গিয়ে গরু ব্যবসায়ীরা বেশি হত্যাকা-ের শিকার হন। কোন প্ররোচনায় যেন গরু ব্যবসায়ীরা সীমান্ত পার না হয় সে জন্য তিনি গরু ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন,তার এই আহ্বান এর পিছনে কারণ হল মানুষের জীবন রক্ষা করা।
এদিকে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এখন বেজায় খুশি। তার দাবি, এটা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে গরু পাচার রুখতে বিএসএফের সাফল্যের প্রমাণ। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, সেদিন বাংলাদেশের হাইকমিশনার আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে গরু পাচার নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম – তখন রাষ্ট্রদূত জানালেন সীমান্তে এই কড়াকড়ি শুরু হওয়ার পর সে দেশে বিফের দাম না কি ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। শুনে আমি খুশি হয়েছি।
ভারতের শাসক দল বিজেপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে গোরুকে গোধন বলে বর্ণনা করে থাকে, এবং দেশের বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতেও গোমাংস নিষিদ্ধ করার জন্য নানা উদ্যোগ রয়েছে। ‘রাষ্ট্রীয় গোধন মহাসঙ্ঘ’-র সেমিনারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং-ও জানান, এই পদে আসার এক মাসের মধ্যেই তিনি ঠিক করে ফেলেছিলেন যে কোনওভাবে হোক বাংলাদেশে গরু পাচার রুখবেন।
রাজনাথ সিং আরো জানান, প্রথমবার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সফরে গিয়েই আমি জওয়ানদের বলেছিলাম আমার এই সফর তখনই সার্থক হবে যখন সীমান্ত পেরিয়ে আর একটি গরু ও বাংলাদেশে যেতে পারবে না। সেই কাজে তারা দারুণ সফল হয়েছেন।
মন্ত্রী অবশ্য সেই সঙ্গেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষের বিফ কিনতে কষ্ট হচ্ছে বলে তিনি খুশি নন, তিনি খুশি ভারত থেকে গরু পাচার কমছে বলে। রাজনাথ সিং আরও বলেন, ভারতে যে কোনও জনদরদী সরকারের উচিত গরিষ্ঠ হিন্দুর ভাবাবেগকে মর্যাদা দিয়ে গোহত্যা নিরুৎসাহিত করা। তার এই যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে রাজনাথ সিং ইতিহাস থেকে মুঘল ও ব্রিটিশ শাসকদের দৃষ্টান্ত টেনে আনেন।
তার ভাষায়, মুঘল বাদশাহরা ভারতে শত শত বছর রাজত্ব করতে পেরেছিলেন কারণ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তারা কখনও গোহত্যায় উৎসাহ দেননিৃ মুঘল বাদশাহরা এই বাস্তবতাটা জানতেন অবাধে গোহত্যার অনুমতি দিলে বা গোমাংস খেতে দিলে প্রজাদের মন পাওয়া যাবে না – রাজত্বও বেশিদিন টিকবে না। এমন কী বাবরও তার উইলে সে কথা লিখে গেছেন। কিন্তু ইংরেজ শাসকরা আসার পরই ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতি ও পরম্পরাকে তারা উপেক্ষা করা শুরু করলেন।
ভারতীয় ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কিংশুক চ্যাটার্জি অবশ্য মনে করেন, হিন্দুদের সংবেদনশীলতা নিয়ে মুঘল ও ব্রিটিশরা উভয়েই সচেতন ছিলেন।
তিনি বলছেন, আকবরের নির্দেশ ছিল জবাইখানাগুলো যেস শহরের পরিধির বাইরে হয়। অন্য মুঘল বাদশাহরাও সেই রীতি বজায় রাখায় কোনও সমস্যা হয়নি। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে শহরের সীমা বাড়তে বাড়তে যখন সেটাকে ছুঁয়ে ফেলল, তখনই গন্ডগোলের শুরু। ব্রিটিশ জমানায় ১৮৯২-৯৩ সালে প্রথম যে বড় দাঙ্গা হয়েছিল, তার পেছনেও ছিল এই কারণ।
এখনকার বিজেপি আমলে সরকার অবশ্য এই জবাইখানাগুলোই পুরোপুরি বিলোপ করার কথা বলছে – যদিও তারা সে ব্যাপারে আইন প্রণয়নের ভার ছেড়ে দিচ্ছে রাজ্য সরকারগুলোর ওপরেই। এমন কী, দুধ দেওয়া বন্ধ করার পর ভারতের গরু ঠিকানা যাতে বাংলাদেশ বা জবাইখানা না-হয়, তার জন্য নিখরচায় তাদের পশুখাদ্য দেওয়ার প্রস্তাবও সরকারের বিবেচনায় আছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তবে সীমান্ত দিয়ে যারা আমদানি রফতানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ধারণা আপাতত বাংলাদেশে গরু আসতে না দিয়ে দাম চড়িয়ে দিয়েছে ভারত। এরপর কোরবানিতে হঠাৎ করে গরু ঠেলে দেয়া হবে বাংলাদেশে। তা বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বের নিদর্শন মনে হলেও এভাবে কোরবানিতে বাড়তি মূল্য বিরাট অর্থনৈতিক ফায়দা তুলে নেবে ভারত। এতে বাংলাদেশে কৃষকরা তাদের গরু বিক্রিতে মার খাবে। ভারত গরু বাংলাদেশে আসতে একেবারেই বন্ধ করে দিলে বিকল্প গরু পালনে বাংলাদেশের কৃষককে কোনো বিশেষ সহায়তা এখনো দেয়া হয়নি। তা দেয়া হলে গরুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভের মুখ দেখতে পারত।